কাচ, সাগর যেখানে শুকিয়ে যায়
২০১৭ সালের শুরুর দিকে বন্ধু জ্যোতি বিকাশ দাস এর সাথে যাই গুজরাট, গোয়া আর মুম্বাই ঘুরতে। সেই ট্যুরের প্রথম কয়েকদিন নিয়ে এই লেখাটি। লিখেছে বন্ধু জ্যোতি বিকাশ দাস
[জায়গাটা সমুদ্রের কাছে, বছরের বড় একটা সময় মোটামোটি জলাবদ্ধ থাকে। তাই, যখন পানি শুকিয়ে যায়, পড়ে থাকে লবণের দলা। একটা জায়গায় গিয়ে মনে হয় এই পাশে গুজরাট আর ঐ পাশে পুরো পৃথিবীতে শুধু সাদা লবণ। ডেজার্টের মাঝখানে থাকলে হয়ত মনে হত পৃথিবীতে লবণ ছাড়া আর কিছু নেই। গিয়েছিলাম দুইজন মিলে, ছবি তোলা সব ফোনের দূর্বল ক্যামেরায়। ডি এস এল আর নিয়ে যাবার পরেও কেন ফোনে ছবি তুলেছি সেটা নোটে লিখেছি।]
গুজরাট ট্যুরিজমকে জনপ্রিয় করার জন্য সেখানকার রাজ্য সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে রন উৎসব। গুজরাটের ভুজে, কাচ নামক জায়গায় মোটামোটি তিনমাস ব্যাপী এই আয়োজন। রন উৎসব যেখানটায় হয়, তার পাশেই আছে সল্ট ডেজার্ট। ইন্ডিয়ার ট্যুরিস্ট স্পটগুলো বিভিন্ন ম্যুভিতে এমনভাবে দেখানো হয়েছে যে, সেই জায়গাগুলোকে মনে রাখি ম্যুভির কোন সিন দিয়ে। সল্ট ডেজার্ট হল সেই জায়গা যেখান সোনাক্ষী আর শাহীদ কাপুর সারি কে ফল সা বলে নাচানাচি করেছে।
আমাদের প্ল্যান ছিল এরকমঃ ঢাকা থেকে বাসে কলকাতা, কলকাতা থেকে প্লেনে আহমেদাবাদ, আহমেদাবাদ থেকে ভুজ বাসে, সেখানে রন উৎসব দেখে আবার বাসে আহমেদাবাদ, আহমেদাবাদ থেকে প্লেনে গোয়া। এই প্ল্যান অনুযায়ী এর মধ্যে তিন দিন চলে গেছে কিন্তু আমরা এক রাতও হোটেলে শুই নি, ঘুমিয়েছি বাসে-প্লেনে। আসলে কি হয় দেখা যাক।
কলকাতা
বাংলাদেশের বর্ডার ক্রস করার পরেই অদ্ভুত একটা ট্রানজিশান হয়। মদিনা ভাতের ঘর, আল বাইক রেস্টুরেন্ট থেকে রাস্তার দুই পাশের দোকান গুলো হঠাৎ করে কার্তিক স্টোর, শ্রীগোবিন্দ রেস্টুরেন্ট হয়ে গেছে। বাংলা লেখার ফন্ট গুলোও সিয়াম রুপালি থেকে অজানা কোন ফন্টে পরিবর্তন হয়ে গেছে। মসজিদের জায়গায় এখন সৎসঙ্গ আশ্রম আর মন্দির দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মানুষগুলো দেখতে একই রকম, কথাও বলছে একই ভাষায়। পার্থক্য শুধু মাঝখানের কাঁটাতারের বেড়া।
কলকাতা পৌছানোর পর প্রথম কাজ সিম কেনা, দ্বিতীয় কাজ এপি ফিজ খাওয়া। সেই এপি ফিজ যা আমার আর আলমের অত্যন্ত পছন্দ, দেশে ভেজাল নাকি কিসের দায়ে নিষিদ্ধ হবার আগে পর্যন্ত আমি আর আলম প্রতিদিন একটা করে পান করতাম। খুব আবেগ নিয়ে চুমুক দিচ্ছিলাম, কিন্তু কেন জানি মন ভরছিল না। অনেক দিন পরে তো! ব্যাপারটা অনেকটা সাবেক প্রেমিকার সাথে দেখা করার মত। নস্টালজিয়া আছে, প্রেম নাই, আগের মত ভাল লাগা নাই। যাই হোক, দুপুরের খাবার খেলাম কস্তুরীতে। এর আগের বার যখন এখানে এসেছিলাম, সেবারও কস্তুরীতে খাওয়া হয়েছে। কিন্তু এবার এত মজা লাগছে কেন খাবার? আমাদের অনেক খিদা লেগেছে তাই নাকি খাবারের স্বাদ অনেক ভাল হয়ে গেছে বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ খেয়াল করলাম দেয়ালে টানানো সার্টিফিকেট অনেকগুলা, টাইমস অব ইন্ডিয়ার বেস্ট রেস্টুরেন্ট এওয়ার্ড। টানা কয়েকবছর ধরে তারা এওয়ার্ড পাচ্ছে, শুধু ২০১৪ সাল বাদে। সেবারই এসেছিলাম।
আমি যতবার বাসে-ট্রেনে চড়েছি পাশে সাধারণত উটকো টাইপ লোক বসেছে এক ঘন্টা যাবার পর মুখ হা করে, পা দুইটা নবাবী ভঙ্গিতে ছড়িয়ে দিয়ে, ঘুমের মাঝে মাথাটা আমার কাধের উপর এলিয়ে দিয়েছে। আমি একটু পর পর ঝাঁকুনি মেরে সরিয়ে দিয়েছি।
কলকাতা থেকে আহমেদাবাদ যাব, সবচেয়ে সস্তা ছিল ইন্ডিগোর ফ্লাইট। সেটারই টিকেট করা হল। প্রতি সারিতে দুই পাশে তিনটা করে মোট ছয়টা সিট। জানালার পাশে দুইটা সিট আমাদের। আমি আর আমার বন্ধু মারামারি করছি কে উইন্ডো সিট নিবে। ত্যাগ স্বীকার আমিই করলাম। মাঝখানের সিটে আমি। আবার নিশ্চই এক উটকো লোক এসে পাশে বসবে।
আমার সকল অতীত রেকর্ড ভঙ্গ করে পাশে এসে বসল অতিশয় সুন্দরী তরুণী। বন্ধু তখন আফসোসে মারা যাচ্ছে। অফার দিল উইন্ডো সিট নিব নাকি। বললাম, তুমি মারা খাও। অলরেডি আমার অতীত এক্সপেরিয়েন্সের কথা মনে করে একরকম পুলক অনুভব করছিলাম। হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে কি সুন্দর কুট কুট করে কথা বলছে মেয়েটা ফোনে।
এক বুড়ি মহিলা সিট খুঁজছে। আমার পাশে বসা মেয়েকে এসে বলল, “I think this seat is mine.” আমি দোয়া করছিলাম বুড়ি যাতে ভুল হয়। কিন্তু না, আসলে কন্যাই ভুল করেছে। গেট নাম্বার কে সিট নাম্বার ভেবেছে। ভুল করা কন্যার সাথে আর কথা হল না। উঠে সামনে চলে গেল।
উইন্ডো সিটে বসা বন্ধু আমার মিস্টার বিনের ম্যুভি দেখেও এত মজা পায়নি এমন ভাবে হেসে যাচ্ছিল। সিট চেঞ্জ করার অফারটা এখনো আছে নাকি জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম, সাহস পাইনি। পাশে বসা বৃদ্ধা মহিলা তার চারপাশে দশ গ্রামের সবার সাথে গল্প করে যাচ্ছে। অন্না, পুরান্না, ইল্লে কিল্লে সল্লে।
ভুল করা কন্যার দুঃখ ভুলে গিয়েছি হেড ফ্লাইট এটেন্ড্যান্টকে দেখে। সে প্রফেশনাল, খুব স্বাভাবিক সে খুব সুন্দর করে কথা বলবে, সেজেগুজে থাকবে। কিন্তু তার পরেও তার মধ্যে একটা পাশের বাসার মেয়ে টাইপ ব্যাপার ছিল, ব্যাপারটা ফেইক ছিল না। নাম শঙ্খমিত্র, বাঙ্গালী। পিছনের এক ব্যাক্তি প্লেনের ভেতর মশা কেন বলে ঝামেলা শুরু করল। শঙ্খমিত্র এসে ঝামেলা মেটানোর চেষ্টা করল। ঐ বেটা প্রায় ১৫ মিনিট ধরে প্যাঁচাল করল। কিভাবে পারে এত সুন্দর একটা মেয়েকে কটু কথা বলতে!
আমার বন্ধু আলম তার চেহারা দেখে জানাল, সে নাকি দেখতে হুবুহু তার সাবেক গার্লফ্রেন্ডের মত। খাবার কোনটাই ফ্রী ছিলনা, পানি ছাড়া। আলম ফ্লাইট এটেন্ড্যান্টকে ডেকে পানি চায়। কিন্তু শঙ্খমিত্র আসে না, সে বিজনেস ক্লাসের ওখানে সার্ভ করে। আজ গরীব বলে শঙ্খমিত্রর কাছ থেকে পানি পেল না আলম! মেয়ে কত লম্বা আন্দাজ করতে পারছিলাম না, অনেক লম্বা মনে হচ্ছিল। ভেবেছিলাম দেড়-দুই ফিট হিল পরেছে হয়তো। নামার সময় খেয়াল করি, পুরাই ফ্ল্যাট জুতা। আলম এখনো ইন্ডিগোর এমপ্লয়ি লিস্টে শঙ্খমিত্রকে খুঁজে বেড়ায়।
আমি এর আগে প্লেন জার্নি করেছি দিনের বেলা। উপর থেকে মাটির দিকে তাকালে মনে হয় গুগল ম্যাপ দেখছি, শুধু একটু বেটার ইমেজ কোয়ালিটি, কুইকবার্ড কিংবা আইকোনোস হবে হয়ত। মেঘের উপর দিয়ে যাবার সময় মেঘগুলোকে রাফ একটা সারফেস মনে হয়। মনে হয় এখুনি নেমে ওখানে হাঁটা শুরু করি। আমরা আহমেদাবাদের কাছাকাছি, প্রায় নয়টা বাজে তখন। আলম জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে বলল। একটা শহরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি। লাইটগুলো দেখে মনে হচ্ছে জায়গায় জায়গায় আগুণ লেগেছে। রাস্তার দুইপাশে লাইট দেখে হঠাৎ মনে হবে আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা বের হয়ে যাওয়া দেখছি, রাতের বেলা। নিচের জিনিসগুলো খুব তুচ্ছ মনে হয়। পাখিগুলো আকাশে উড়ার সময় আমাদের হয়ত তাই ভাবে, খুব তুচ্ছ, খুব নগন্য, আমি পাখি, যেকোন জায়গায় যেতে পারি, পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না।
আহমেদাবাদ
আহমেদাবাদ পৌছালাম, খুব বেশী রাত না তখন। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে অটো নিলাম, গন্তব্য পালদি, সেখান থেকে বাসে করে যাব ভুজ। ড্রাইভার বলল মিটারে যাবে। আমরা সানন্দে রাজী। রাত ৯.৩০-১০ টার মত বাজে। আহমেদাবাদে এমনিতেই খুব একটা লোকজন থাকে না, এমন সময়ে রাস্তা আরো ফাঁকা। আমাদের ইন্ডিগোর প্লেন যে স্পিডে এসেছে মোটামোটি সেই স্পিডে টানা শুরু করল ড্রাইভার। যেসব টার্ন নিচ্ছিল, অল্পের জন্য বাসে লাগে না, অন্য অটোতে লাগে না, কোন মানুষের গায়ে ধাক্কা লাগে না, লাগে আমাদের হৃদপিণ্ডে। আমি আলমকে বললাম, দোস্ত, আজকে মারা গেলে খবরটা বাপ-মা রে দিস, আমার ফোনে ফেইসবুকে লগ আউট করে দিস, খবরদার কোন মেসেজ পড়বি না, রাজু ২৫০ টাকা পায়, দিয়ে দিস আমার হয়ে।
অবশেষে পালদি পৌছালে ড্রাইভার আমাদের মিটার দেখাল, রিডিং ৮০০ সামথিং এর ঘরে। দেখে পুরা মাথা নষ্ট অবস্থা। এই ডিস্ট্যান্স কিভাবে ৮০০ রুপি হয়! পড়ে সে কিজানি একটা কাগজ বের করে দেখাল, রিডিং ৮০০ হলে ভাড়া তিনশ সামথিং। আমাদের কাছে আরো কি ব্রীজের টোল-মোল বলে মোটামোটি ৪০০ রুপি নিয়ে নিল। ইন্ডিয়া আসার পর ইহা আমাদের প্রথম মারা খাওয়া। পরে নেটে দেখে বের করেছিলাম, এই ডিস্ট্যান্স এর অটো ভাড়া ১৫০ রুপির এক রুপিও বেশী হবার কথা না।
পালদি পৌছে হঠাৎ খেয়াল হল আমাদের খাওয়া দরকার। কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকতে গেলাম। দারোয়ান জিজ্ঞেস করল, কাহা জায়েঙ্গে? আমি মনে মনে ভাবলাম, ভাই রেস্টুরেন্টে ঢুকছি, সার্কাস কিংবা পুতুল নাচ দেখার জন্য ঢুকছি না অবশ্যই। দারোয়ান ভেতরে কাকে জানি বলল, দুইজন আসছে, জায়গা হবে নাকি। আচ্ছা, এই তাহলে কারণ, রেস্টুরেন্টের ভেতর ভীড় লাগাতে চায় না। আমরা কোন ফাঁকা টেবিল পেলাম না, এক আংকেলের সামনে বসে গেলাম।
মেন্যু দেখে খুব একটা সুবিধা করতে পারলাম না। আমরা আংকেলের কাছে পরামর্শ চাইলাম। আংকেল ভাল লোক, কোন খাবারে কি থাকবে জানাল। আমাদের হিন্দী শুনে মোটামোটি অবাক হল, জানাল আমরা বেশ ভাল মতই পার পেয়ে যাব এই হিন্দী দিয়ে। কোন একটা থালি নিয়েছিলাম, রুটি ছিল, একটু ভাতও ছিল, খারাপ না খাবার। আংকেল মুম্বাই এর লোক, মুম্বাই যেতে মানা করল। ট্রাফিকের জন্য নাকি মুভ করতে পারব না। আমি মনে মনে ভাবি, আংকেল একবার ঢাকা এসে ট্রাফিক দেখে যান। ঢাকায় সার্ভাইভ করা লোক আমরা, ট্রাফিক ভয় পাই না।
আমাদের দেশের বাস সার্ভিসগুলোর কত সুন্দর নাম, রয়েল, ঈগল, ইউনিক, শ্যামলী। আর এখানে বাস সার্ভিসের নাম আত্মারাম, স্বামী নারায়ন, শ্রী শাহজানন্দ ট্রাভেলস। টিকেট করা হল শাহজানন্দ এর বাসের। Volvo B11R, Multi Axle সেমি স্লিপার বাস। বাহারী নাম, কিন্তু বাস এবং সার্ভিস দুটোই যাচ্ছেতাই। ইন্ডিয়ানরা তাদের ট্রেন সার্ভিস এত ভাল করেছে যে বাসের দিকে নজর দেয়ার সময় পায় নি। বাসের নাম্বারিং সিস্টেম খুব অদ্ভুত। A0, A1 থেকে শুরু করে হঠাৎ করে 1,2,3,4 একপাশে, তার পর আবার 5,6,7,8 অন্যপাশে। আমাদের সিট খুঁজে পেতে খবর হয়ে গেছে। আবার সিট পাবার পর দেখি সিট পানিতে ভেজা। কোন পানি, কিসের পানি আল্লাহ্ মালুম। আমাদেরকে অন্য সিট দেয়া হল চেঞ্জ করে।
ভুজ
সকালে ভুজ পৌছানোর পর আমি বাসে ওভারহেড বক্স থেকে ব্যাগ নামাতে গিয়ে দেখি আলমের ক্যামেরার ব্যাগ নাই। আলমকে ঘুম থেকে তুলে যখন বললাম ক্যামেরার ব্যাগ নাই, সে ফাইজলামি করছি ভেবে আবার শুয়ে পড়ল। একটু পরে আসলেই বুঝতে পারল ফাইজলামি করছি না, তখন পুরো বাস তন্ন তন্ন করে খোঁজা শুরু হল। ক্যামেরা ছিল, সিম কার্ড ছিল, আলমের ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, নগদ অর্থ, All are gone. তখন থেকে শুরু হল আমাদের সার্ভাইভাল স্টোরি।
ভোর হচ্ছিল তখন মাত্র, লোকজন রাস্তায় বের হওয়া শুরু করেছে মাত্র। ভ্যানের উপর সব্জি আর ফল সাজানো হচ্ছে। পুরো ভ্যান ভর্তি একেবারে সিঁদুরের মত লাল আম, অন্য আরেকটা ভ্যান ভর্তি ডালিম, তার পাশেরটায় গাজর। এত লম্বা গাজর আমি জীবনে দেখিনি। এখানকার গরুগুলোর শিং এর মত। সবকিছু কেমন জানি লম্বা টাইপ। আমরা হোটেল খুঁজে বেড়াচ্ছি। ইন্ডিয়ায় হোটেল ভাড়া বেশী নাকি আমাদের বলদ মনে করে ভাড়া বেশী চাচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না।
যাই হোক, আমাদের টানা তিন দিন হোটেলে না থাকার প্ল্যান এর মধ্যে মাঠে মারা গেছে। শরীর আর কুলাচ্ছিল না। হোটেলে পৌছে আলম আমাদের সাথে যারা বাসে এসেছে লিস্ট ধরে তাদের কল দেয়া শুরু করল। আলম প্রথমে ইংলিশ বলার চেষ্টা করে, কেউ ঠিকমত বুঝে না। পরে তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে কি যে বুঝাল আলমই জানে! ভাইসাব, আপনে হামারা ক্যামেরা চরি কিয়া হে কিয়া? এই টাইপ কিছু হবে হয়ত। কেউ কি ক্যামেরা চুরি করে নিয়ে গেলে বলবে যে, “হা ভাই, চুরা লিয়া মাজাক কারকে। আব হামারা গার্লফ্রেন্ডকে সাথ দো ফটো খিঁচকে আপকো ভাপাস দে দেঙ্গে!”
দুপুর পর্যন্ত ঘুমালাম। এখন আমাদের কাজ হবে আশেপাশের সবচেয়ে সস্তা রেস্টুরেন্টটা খুঁজে বের করা। মোটামোটি একটা রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিলাম গুজরাটি থালি। মেন্যু গুজরাটি ভাষায় লেখা ছিল। ভাগ্যিস উল্টা পাশে ইংলিশ লেখা ছিল, নাহলে জয়নুল আবেদীনের মত খাতা পেন্সিল নিয়ে বসতে হত। ওয়েটার আমাদের বলল পাশের কামরায় যেতে হবে। একই রেটুরেন্টের এক পাশে পাঞ্জাবী আর এক পাশে গুজরাটি খাবার। প্রথমে বড় একটা থালা দিয়ে তাতে কয়েকটা ছোট ছোট বাটি দেয়া হল। তারপর একের পর এক জিনিস আসছিল। লাচ্ছির মত দেখতে প্রায় মাঠার মত স্বাদ এমন এক গ্লাস তরল – খুবই বাজে; ছানার সন্দেশের মত দেখতে চাল দিয়ে বানানো কিছু একটা – জঘন্য স্বাদ; চাটনী টাইপ কিছু একটা – খুবই টক; দুইটা রুটি আর ডাল দিয়ে দুপুরের খাবার সারলাম। এই জায়গায় আমাদের খাবার দাবার বিষয়ক খবর আছে। আমার না হয় পাতলা দেহ, আমার সাথে থাকা ১২০ কেজির কি হবে?
কাচ
একটা জায়গাকে ডেজার্ট বলার জন্য কি হতে হয়, সেখানে গাছপালা কম থাকতে হবে নাকি মানুষ থাকা যাবে না। ডিকশনারিতে দেখেছি আসলে, দুটোই হয়। রাস্তা মোটামোটি সোজা, ড্রাইভার মনে হয় ফিক্স গিয়ারে দিয়ে বসে আছে। দুই পাশে লোকজনের বসতি নাই, গাছপালাও কম। শুধু ঠিক রাস্তার পাশে কিছু কালারফুল গাছ। জংলী ফুল, কিন্তু খুবই সুন্দর, কোনটা লাল, কোনটা বেগুনী। গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে দিয়েছি। বাতাস এসে চুলের বারটা বাজাচ্ছিল আর মনে হচ্ছিল লাইফ ইজ বিউটিফুল।
এই এলাকার লোকজন কি করে ইনকাম করে বুঝে পেলাম না। কেন থাকবে লোকজন এখানে? আমি আলমকে রাস্তায় বিভিন্ন রোড মার্কিং আর স্ট্রিট সাইন এর মানে বুঝাচ্ছিলাম। এক জায়গায় দেখি স্ট্রিট সাইনে মহিষের ছবি আঁকা। এমন সাইন আমি জীবনেও দেখি নাই। এই জিনিস ব্যাখ্যা করতে পারছিলাম না। একটু সামনে দেখি রাস্তার মাঝখানে মহিষের দল সাহেবী ভঙ্গিতে বসে আছে। এবার বুঝতে পারলাম, স্ট্রিট সাইনে মহিষের মানে হল, সামনে মহিষ আছে, যারা আপনাকে পাত্তাও দিবে, Drive at your own risk.
এই এলাকায় লোকাল লোকজনের আয়ের অন্যতম উৎস হল মহিষের দুধ। ড্রাইভার আমাদের জিজ্ঞেস করল আমরা মাওয়া (Mava) খাব নাকি। কি জিনিস জিজ্ঞেস করিনি। এক গ্রামের বাজারের মত জায়গায় গাড়ি থামাল। আমরা মাওয়া খেলাম। মাওয়া হল মহিষের দুধের ক্ষীর, অতিরিক্ত মিষ্টি, কিন্তু স্বাদ মুখে লেগে থাকে।
রাস্তার দুই পাশে যত দূর দেখা যায় ফাঁকা জায়গা, সমতল ডেজার্ট। ড্রাইভার জানাল শাহরুখ খান নাকি একটা পাকিস্তানী মেয়েকে জালিমা বলে নেচে নেচে গান গেয়ে গেছে এখানে। আলমও তার বলিউড জ্ঞান ঝাড়ল একটু। আশুতোষ গোয়ারিকার এখানে ফাঁকা একটা জায়গায় ম্যুভির সেট হিসেবে একটা পুরো গ্রাম বানিয়ে ফেলেন। সেখানে লাগান ম্যুভির শ্যুটিং হয়। হৃত্বিক এর মহেনজো দারোও এখানে শ্যুট করা হয়েছে।
কালা দুঙ্গার
আমাদের প্রথম গন্তব্য কালা দুঙ্গার, এখানকার উচ্চতম জায়গা। কালা দুঙ্গার থেকে পুরো সল্ট ডেজার্ট নাকি দেখা যায়। সমতল রাস্তা শেষ হয়ে হালকা পাহাড়ি রাস্তায় প্রবেশ করি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আমাদের গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি কি হল, সে কিছু বলে না। আমাদের দেখাল যে গাড়ি অটোমেটিক সামনে আগাচ্ছে, যদিও রাস্তা সামনে উপরের দিকে উঠছে। আজব ব্যাপার! ঢালু রাস্তায় গাড়ি নিচের দিকে নামার কথা, এ তো উপরে উঠছে। ড্রাইভার আমাদের কোন এক আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করল।
আসল কারণটা আমি জানতাম। গ্র্যাভিটি হিলের অভিজ্ঞতা হল এই প্রথম। ইউটিউবে অনেক ভিডিও আছে। সৌদী আরবে এরকম এক জায়গাকে আল্লাহর কুদরত বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই জিনিস। ইন্ডিয়াতে এই জিনিস হয়ত ভগবানের কুদরত হবে। কিন্তু আসলে পৃথিবীর অনেক জায়গায়ই এই জিনিস এক্সপেরিয়েন্স করা যায়। গ্র্যাভিটি হিল বা ম্যাগনেটিক হিল বলে। জিনিসটা আমি এক্সপ্লেইন করতে পারব, কিন্তু আমার ট্রাভেল ব্লগকে আমি ফিজিক্স ক্লাস বানাতে চাই না। একেবারে শেষ অংশে আলাদা করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। কারো আগ্রহ থাকলে পড়ে দেখতে পারেন।
কালা দুঙ্গার অনেক বড় ডিজেপয়েনমেন্ট ছিল। উঁচু জায়গা থেকে নিচে তাকাতে ভাল লাগে। কিন্তু এনভায়রনমেন্ট পরিষ্কার না থাকায় দূরে দেখা যাচ্ছিল না। তবে বেশ ভাল বাতাস ছিল, অত খারাপও লাগছিল না। পাহাড়ের একপাশে বসার জায়গায় দুইজন শুয়ে পরলাম। এই রোদে সল্ট ডেজার্ট যাওয়া যাবে না। জীবনে কি পেলাম আর না পেলাম ভেবে দুইজন সিরিয়াস আলোচনা শুরু করলাম।
রন উৎসব, কাচ
ইন্ডিয়ায় ট্যুরিজমকে একটু গুছিয়ে এনে খুব সুন্দর বিজনেস চালু হয়েছে। রন উৎসব আসলে কিছুই না, মরুভূমির মাঝখানে একটা অস্থায়ী শহরের মত বানানো হয়েছে। টাকা-পয়সাওয়ালা লোকজন এসে থাকার জন্য টেন্ট সিটি। অস্থায়ী রাস্তা, লাইব্রেরী, মিউজিয়াম, খাবার দোকান, শপিং প্লেইস, গান-বাজনা শোনার ব্যবস্থা সবই আছে এখানে। শপিং আমাদের কাজ না, প্রথম কাজ খাওয়া।
আবারো সেই থালি মালি কিছু একটা খেয়ে নিব প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু অর্ডার করলাম ভেজ পুলভ। আসার পরে দেখি এ তো ভেজ পোলাও, পুলভ কোথায়? Pulav লেখা ছিল মেন্যুতে, পোলাও না পড়ে পুলভ পড়েছি। আমার কোন দোষ নাই। এরা মাওয়া কে Mava লিখবে, পোলাও কে Pulav. আলম Pav Bhaji খেতে চেয়েছিল। Pav কে উচ্চারণ করতে হবে পাউ। পাউ ভাজি প্রায়ই টিভিতে, ম্যুভিতে শোনা যায়। আলমকে ছবি দেখালাম, পাউ হল পাউরুটি আর ভাজি হল ভাজি। সে খাবার ইচ্ছা পোষণ করল না আর।
একটু বিকাল না হলে সল্ট ডেজার্টে যেতে যাচ্ছিলাম না। মরুভূমির মাঝখানে দুপুরবেলার রোদ খাবার কোন মানে নেই। সল্ট ডেজার্টে যাবার জন্য অনেক নিরাপত্তাজনিত ব্যাপার স্যাপার পার হতে হয়। ডেজার্টের অপর পাশেই পাকিস্তান কিনা। ডেজার্টে যাবার জন্য আমাদের প্রথমে টিকেট কাটতে হবে, যা দিয়ে আমাদের একটা বাসে উঠিয়ে দিবে। সেই বাস এক কিলোর মত যাবে, সেখান থেকে আবার উট অথবা গাধায় টানা গাড়িতে সল্ট ডেজার্টে যেতে হবে।
আমরা যখন টিকেট করতে যাব তখন বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেখে একটু ইতস্তত করছিল। আমাদের পাসপোর্টের জেরক্স কপি জমা দিতে বলল। এবার হল জ্বালা, জেরক্স কপি তো নাই। কি করা যায়? আমাদের ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল আমরা আশেপাশে কোন বাজারে গিয়ে দেখতে পারি আছে নাকি। ড্রাইভার যখন জানতে পারল আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি সে বলল আমরা আগে কেন জানালাম না। এখানে নাকি বাংলাদেশী আর পাকিস্তানীদের প্রবেশ নিষেধ। সে আমাদের কোন আর্মি পার্সোনেলের সাথে কথা বলতে মানা করল। একটু আগেই আমি এক আর্মির সাথে কথা বলে এসেছি পাসপোর্টও দেখিয়ে এসেছি, কিছুই বলে নাই।
এখানে এরা এখনো ফটোকপিকে জেরক্স কেন বলে আমি জানি না। জেরক্সের যুগ সেই কবেই শেষ হয়েছে। যাই হোক, আমাদের আরেক মরুভূমি মার্কা গ্রামে নিয়ে গেল ড্রাইভার। ফটোকপির দোকান আছে, কিন্তু তা বন্ধ। পরের গন্তব্য কাছাকাছি একটা রিসোর্ট। হোটেল-রিসোর্টের রিসেপশানে ফটোকপি মেশিন থাকেই সাধারণত। সেখানে ফটোকপি করে ব্যাক করলাম। এতক্ষণ খুব অলস সময় যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে হল লাইফে এক্সাইটমেন্ট চলে এসেছে।
হোয়াইট ডেজার্ট, কাচ
সল্ট ডেজার্টে নিয়ে যাবে যে বাসে করে, পুরো ব্যাপারটা বেশ প্রহসন মনে হল। বাস পুরো রাস্তা যাবে না, মাঝখানে নাকি আবার উটের গাড়িতে চড়তে হবে। তারা হয়ত সাধারণ মানুষের ইনকামের একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে। চাইলে পুরো রাস্তাই বাস যেতে পারত। বাস থেকে নামার পর আমরা উটের গাড়িতে না চড়ে হাঁটা শুরু করলাম। কোন একটা ইন্টারেস্টিং জায়গায় যাবার আগে একটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করে, আমাদের এক্সাইটমেন্ট এমনিতেই অলরেডি বেশী। ডেজার্টের মাঝখানে সোজা রাস্তা, প্রথম অংশে দুই পাশে বালু, আর রাস্তার শেষ যেখানে তার আশেপাশে শুধু লবণ আর লবণ। আমাদের তর সইল না, রাস্তার শেষ অংশে পৌছানোর আগেই রাস্তা থেকে নেমে গেলাম। পায়ের নিচে বালু ছিল কিছুক্ষণ, আগাচ্ছি আর বালুগুলো হঠাৎ করে লবণ হয়ে গেল।
এক এক অদ্ভুত ব্যাপার, আমি বরফের উপর হেঁটেছি এর আগে। লবণের উপরে হাঁটা অনেকটা বরফের উপর হাঁটার মতই, কিন্তু লবণ একটু বেশী নরম আর জুতার নিচে লেগে থাকে। আমাদের উদ্দেশ্য হল লোকজনের ভিড় থেকে দূরে যাওয়া। যতই দূরে যাচ্ছি চারপাশে শুধু সাদা লবণ আর লবণ। প্রত্যেকটা পা ফেলছি আর আমার মনে হচ্ছিল আমিই প্রথম মানব যে এখানে পা রেখেছে। আলম কিছু শোয়া ফটোগ্রাফি করল। কিন্তু ফোনে ঠিক মনমত হচ্ছিল না। আমরা দুইজনই হারানো ডি এস এল আর কে মিস করা শুরু করলাম। আলম গালি দিচ্ছিল ক্যামেরা চোরকে, তুই দোজখে যাবি, তোর কোনদিন বাচ্চা হইব না, এই ক্যামেরা দিয়া যার ছবি তুলবি সে মইরা যাইব।
দুইজন এবার লবণের উপর বসে পরলাম। মুন ক্যালেন্ডার দেখেছি, আকাশে চাঁদ উঠবে রাত ১২ টার দিকে। এখানে চাঁদ দেখা গেল মন্দ হত না। একটু পরেই সূর্য্য ডুবে যাবে। এই সাদা মরুভূমির মনে হয় কোন শেষ নাই। মানুষ মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখে। সে এমন একটা জায়গায় আটকে গেছে, চারপাশে যতদূর তাকানো যায় আর কেউ নেই, কিছু নেই। শুধু সাদা মরুভূমি। এটা যদি স্বপ্ন হয়, মন্দ হয় না। এখানেই আটকে থাকি। কি দরকার আবার সেই টাকা ইনকামের ধান্দা, লাইফে সেটেলড হবার চিন্তা, হাজারো সম্পর্কের কমপ্লেক্সিটি, থাক না দূরে সব কিছু। আজ মাথার সব চিন্তাকে সাদা রঙ করে দিলাম।
সাদা চিন্তাকে আবার কালো করে দিল আমাদের ড্রাইভার। ফোন দিল সে আমরা ব্যাক করছি কিনা। তার এখানে আসার অনুমতি ছিল না। আমরা জানালাম এক্ষুনি ফিরছি। ফেরার পথে এবার না হয় উটের গাড়ি ট্রাই করে দেখি, খারাপ হবে না বিষয়টা। উটের চলার মধ্যে এক ধরণের ছন্দ আছে, সমান বিরতিতে দুলুনি দিতে থাকে। যেখানে আমাদের গাড়ি রাখা ছিল সেখানে পৌছানোর পর আমাদের ড্রাইভার জানাল আমরা এত লেইট করছি কেন? আমাদের আতংকবাদী হিসেবে বসিয়ে দিবে। ড্রাইভারের ভাষায়, একটু আগে এখানে দো বাংগাল লোগোকো বেঠা দিয়া। বাংলায়, দুইজন বাংলাদেশীকে বসিয়ে দিয়েছে। আমরা ভাবলাম কি অদ্ভুত ব্যাপার! বেড়াতে এসেছে লোকজন, তাদের বসিয়ে দিবে কেন? আসলে কিছুই না, সে দ্রুত বাড়িতে ফিরতে চায় আমাদের ভয় দেখিয়ে। কিন্তু আমরাও তো সহজে ছাড়ব না। জানালাম, আমাদের প্রচন্ড খিদা লেগেছে, আমরা টেন্ট সিটিতে গিয়ে খাব।
বেচারা আবারো হতাশ হয়ে বলল, দ্রুত খাবেন, যাতে কেউ টের না পায়। খুব অদ্ভুত ফিল হচ্ছিল, এই বেটা আমাদের পলাতক আসামীর মত ফিল করানোর চেষ্টা করছে।যাই হোক, আমরা যত সম্ভব আস্তে আস্তে খাই, লাইব্রেরীতে ঘুরি, একটা প্রদর্শনী টাইপ হচ্ছে সেখানে ঘুরে বেড়াই। অবশেষে গাড়িতে ফিরলাম যখন, ড্রাইভার বেশ বিরক্ত। সে হয়ত ভেবেছিল আজকে বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরবে, বউয়ের সাথে রোমান্টিক সময় কাটাবে। আমরা দুইজন সিংগেল যুবকের কি এই জিনিস সহ্য হয়! ড্রাইভার আমাদের বলতে লাগল এখানে বাংলাদেশীদের খুব ঝামেলা করে, আর মোহামেডান হলে তো কথাই নাই। একটু সময় লাগল আমার বুঝতে, মোহামেডান মানে মুসলমান। আলম জানাল, আমি মোহামেডান না, আমার মাসি-পিসী অনেক কিছু আছে এই দেশে, আমার কোন ভয় নাই।
সেদিন রাতে হোটেলে কাটিয়ে ভোরবেলা বাসে করে রওনা দেই আহমেদাবাদের উদ্দেশ্যে। সেই একই বাস, যেটাতে আলমের ক্যামেরা চুরি হয়েছে।
এবার জার্নি দিনের বেলা, রাতের বেলা জার্নি করলে কিছুই দেখা যায় না। ভুজ থেকে বের হলে কিছু পাহাড়-টাহাড় দেখা যায়। দূরে দুই একটা ঝর্ণাও দেখেছি। কিন্তু অধিকাংশ জায়গায় ল্যান্ডস্কেপ খুব বোরিং। দেশে ট্রাভেল করার সময় রাস্তার দুই পাশে যেমন ধানক্ষেত দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে যাই, এখানে দুই পাশে মরুভূমি টাইপ ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে যাই। বাসে ম্যুভি প্লে করেছে। আমাদের প্ল্যান ছিল একটা সিনেমা হলে “জলি এল এল বি” ম্যুভিটা দেখব। দোয়া করছিলাম যেন এই ম্যুভি ছেড়ে না বসে। ছাড়ল হৃত্বিক এর কাবিল, দেশী ডেয়ারডেভিল।
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। আমি খোলা জানাল, তুমি ঐ দখিনা বাতাস। এসি বাসে দখিনা বাতাস ঢুকে না।ঐখানে বিশাল এলাকা জুড়ে অনেক গুলো উইন্ড টারবাইন। টারবাইনের ব্লেডগুলো এত বড় হবে ভাবি নাই। ব্লেডগুলো ঘুরতে থাকে আর আমার চোখ সেটা ফলো করে ঘুরতে থাকে। শেষে আমার মাথা ঘুরতে থাকলে ব্লেড ফলো করা বাদ দিলাম। গুগল ম্যাপে দেখি আমরা মোটামোটি সাগরের পাশে দিয়ে যাচ্ছি। এর প্রমান পেলাম রাস্তার এক পাশে লবণের স্তূপ দেখে। পুরো আহমেদাবাদ দেখি লবণময়। আহমেদাবাদ পৌছে কি কি দেখব তা মার্ক করে রাখি গুগল ম্যাপে।
আহমেদাবাদ পৌছে প্রথম কাজ খাওয়া, দ্বিতীয় কাজ সবরমতি আশ্রমে যাওয়া। সবরমতি নদীর তীরে গান্ধীজীর আশ্রম, যাদুঘর টাইপ জায়গা। আমরা টায়ার্ড ছিলাম। আশ্রমের ভেতর একটু ঘুরে টুরে নদীর পাড়ে গিয়ে বসি। এখানে নদীর পাড় পুরাটাই বাঁধানো, ন্যাচারাল কোন ব্যাপার নাই। খুব টায়ার্ড ছিলাম, গাছে বেজীগুলোর উঠা-নামা দেখে সময় কাটাচ্ছিলাম। আলম পিছনে তাকাতে বলল। দেখি সদ্য বিবাহিত দম্পতি, সাথে আরো কিছু লোকজন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। জামাই লম্বা শেরওয়ানী পরেছে, গলায় টাকার মালা ঝুলছে, বউ বিয়ের শাড়ি পরা, দুনিয়ার অলংকার। সাথে বরযাত্রী মার্কা ৪-৫ জন বেশ ফিটফাট। আমি ভাবলাম নবদম্পতি গান্ধী আশ্রমে কি করে! নিশ্চই গান্ধী বাবার দোয়া নিতে এসেছে, সারাজীবন যাতে অহিংসাবাদী থাকতে পারে। লোকজন বিয়ের পর হানিমুনে সাগর দেখতে যায়, এরা যাদুঘর দেখতে আসছে, বেশ জ্ঞানপিপাসী দম্পতি হবে।
আশ্রম থেকে আমরা জৈন মন্দিরে যাই, জামে মসজিদে যাই, তেমন বেশী ইন্টারেস্টিং না। আমরা এর মধ্যে অটো ভাড়া কেমন হবে রপ্ত করে ফেলেছি। আর কেউ ঠকাতে পারবে না। আমরা একটা শপিং সেন্টারে ঘুরতে যাই। বিগ বাজারে ঘুরি আর পোলো শার্ট পছন্দ হয়, টিশার্ট আর জার্সি পছন্দ হয়, কিন্তু কিনতে পারি না। আলম তার ক্রেডিট কার্ডটাকে খুব মিস করে। আমি ওর ক্রেডিট কার্ডটাকে ওর চেয়েও বেশী মিস করি। শেষে বিরক্ত হয়ে কানকারিয়া লেকের পাড়ে গিয়ে বসে থাকি। লেকটা পুরোপুরি গোলাকার, লোকজনে ভর্তি। আলম বলে, শালা কি জায়গায় আসলাম, ২৬০০ কিলোমিটার দূরে এসে জিয়া উদ্যানে বসে আছি।
লেকের পাড়ে বিনোদনের ব্যবস্থা, বিভিন্ন রাইড। তার মধ্যে একটা রাইড খুব মজার। বেলুনের মত একটা ট্রান্সপারেন্ট জিনিসে দুই একজন লোক বসিয়ে দিয়ে লেকে ছেড়ে দিবে। বেলুনটা সাইজে অনেক বড়, আর সিলিন্ডার বা গোলাকৃতি। বাচ্চা পোলাপান এর ভেতর ঢুকে ব্যালেন্স রাখার চেষ্টা করে, পারে না। একজন পা দিয়ে আগানোর চেষ্টা করে আরেকজন ভেতরে উল্টে পড়ে যায়। বাচ্চাগুলো হেসে কুটিকুটি হয়ে যায়। এদের দেখে আমাদের একটু রিলাক্স ফিল হয়।
পরবর্তী গন্তব্য ভিন্টেজ কার মিউজিয়াম। লেক থেকে অনেক দূর, কিন্তু এয়ারপোর্টের কাছে। অটো ভাড়া করে চলে গেলাম। ড্রাইভার জানাল আমাদের নাকি ওখানে এক-দেড় ঘন্টার মত লাগবে। আমি ভাবলাম মিউজিয়ামে আধা ঘন্টার বেশী জীবনেও টিকব না। I was wrong. প্রায় দুই ঘন্টা থাকি ঐখানে।
মিউজিয়ামে এন্ট্রি ফির পাশাপাশি ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার জন্য আলাদা একশ রুপি দিতে হবে। ভাবলাম, কোন ছবি তুলব না, একশ রুপি বেঁচে যাবে। অনেক বড় ভুল ছিল। ভিতরে গাড়ি দেখে মাথা নষ্ট। আবার গেটে ফেরত গেলাম, ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলার টিকেট নিয়ে আসলাম। হয়ত এত ছবি তুলতাম না, কিন্তু টাকা দিয়েছি বলে নাকি বেশী ভাল লেগেছে জানি না, তিন চারশ ছবি তুলে ফেললাম আমার ফোনে। Ford 1920, FIAT 1924, AUSTIN 1928, JAGUAR 1959, MORS, HUDSON, CADILLAC, 1933 CHEVROLET, 1923 ROLLS ROYCE সবকয়টার সামনে ছবি নিয়েছি। চাইলে চালানোও যেত কয়েকটা গাড়ি, কিন্তু চালাতেই তো পারি না।
আহমেদাবাদ থেকে রাতের ফ্লাইটে গোয়া যাব। আমার এখনো আমাদের প্রথম কক্সবাজার যাবার কথা মনে আছে। একজন একজন করে ট্রেন স্টেশনে আসছে আর একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরছি। একটু পরেই ট্রেন ছাড়বে, হই হল্লা, গল্প। প্লেনে আমাদের পিছনে একটা গ্রুপের মত ছিল। প্লেন টেক অফ করার সময় তারা উউউউ বলে চিৎকার শুরু করে। আমরা দুইজন হঠাৎ করে একটু বড় হয়ে গেছি ফিল করি। কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই।
গ্র্যাভিটি হিলঃ
একটা কাগজে একটা সরলরেখা আঁকি, এমনভাবে যেন আমার কাছে আমার সাপেক্ষে সেটা মোটামোটি সোজা মনে হয়। এবার কাগজটা যদি একটু ঘুরিয়ে ধরি, সরলরেখার একপাশ নিচু মনে হবে, আরেকপাশ উঁচু। এতে কিন্তু সরলরেখার অরিজিনাল অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়নি, শুধু আমি কিভাবে দেখছি তার উপর নির্ভর করে এক পাশ উঁচু, এক পাশ নিচু মনে হচ্ছে। গ্র্যাভিটি যেভাবে কাজ করে সে অনুযায়ী, পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকা বস্তু সেইদিকে গড়িয়ে যাবে যেদিকে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে দূরত্ব তুলনামূলকভাবে আরেকটু কম। গ্র্যাভিটি হিলেও একই জিনিস হয়, কিন্তু আমাদের এক ধরণের অপটিকাল ইল্যুশনের কারণে মনে হয়, আসলে গাড়ি উঁচু জায়গার দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, গ্র্যাভিটির বিরুদ্ধে। যদিও সেই জায়গাটা আসলে নিচু হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আশেপাশে উপযুক্ত রেফারেন্স এর অভাবে যেদিক নিচু হয়ে যাচ্ছে সেইদিকটাকেই উঁচু মনে হয়। দেয়ালে বাঁকা হয়ে ঝুলে থাকা একটা ছবি আমি যদি ক্যামেরা দিয়ে বাঁকা করে ছবি তুলি, তাহলে সেটাকে ক্যামেরার স্ক্রিনে সোজাই মনে হবে। কিন্তু সিলিং কিংবা ফ্লোর সহ যদি ছবি তোলা হয় তখন বুঝা যাবে যে ছবিটা আসলে বাঁকা। আমি কতটুক বুঝাতে পেরেছি জানিনা। ব্যাক আপ হিসেবে একটা ভিডিওর লিংক দিয়ে দিচ্ছি। এটা দেখলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
লেখা ভালো লাগলে নিচে শেয়ার বাটনে ক্লিক করে শেয়ার করুন
পরবর্তী লেখা গুলোর আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
Ashfaqul Haque
Awesome
Alam Ashraful
Thanks 🙂
আরিফ হোসেন
অনেক সুন্দর এবং গুছানো লেখা। পড়ে ভালো লাগব Boss । সামনে আরো লেখা পাবো আশাকরি। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
admin
লেখা পড়ে ভালো লেগেছে শুনে আনন্দিত :), অন্য ব্লগ গুলোও পড়ে দেখবেন আশা করি