nariman point,mumbai,india

২০১৭ সালের শুরুর দিকে বন্ধু জ্যোতি বিকাশ দাস এর সাথে যাই গুজরাট, গোয়া আর মুম্বাই ঘুরতে। ট্যুরের প্রথম দিনেই গুজরাটে আমার ডিএসএলার,টাকা পয়সা সব চুরি হয়ে যাওয়ায় সেই ট্যুর পরিণত হয় একটা সার্ভাইভাল স্টোরি তে।  সেই ট্যুরের মুম্বাই অংশ নিয়ে লিখেছে বন্ধু জ্যোতি বিকাশ দাস।

মুম্বাই

ভোররাত, রাত আর ভোরের মাঝখানের এই মুহুর্তটা খুবই সুন্দর। হলে থাকতে মাঝেমাঝে সারারাত জেগে থাকতাম। জেগে থাকতে থাকতে যখন ভোর হত, বাইরে তাকিয়ে থাকতাম। চোখের নিমিষে চারপাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। কেউ একজন যেন বদ্ধ ঘরের জানালার পর্দা খুলে দিল। ট্রাঞ্জিশনের মোমেন্টটা খুব কম সময় স্থায়ী হয়। আমি ওয়াশরুমে যেতাম, তখন দেখতাম আশেপাশের রুমের কয়েকজন জেগে উঠেছে। খুব অদ্ভূত ব্যাপার, এখন জেগে উঠেছে যে সেও ভোর দেখবে, কিন্তু আমার মত করে না। সে একটা নতুন দিন শুরু করতে যাচ্ছে, আর আমি ঘুমাতে যাব এখন। তোমার হল শুরু, আমার হল সারা। সারারাত না ঘুমিয়ে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি। ঠিক মাঝরাতে মাথায় যেসব চিন্তা আসে, তা সাধারণ সময়ে আসে না। ইনসমনিয়া, খুব একটা খারাপ না। মানুষ অনেক কিছু উপলব্ধি করে, জীবনকে অন্যরকম ভাবে দেখে।
বাস চলার সময় দুলুনিতে ঘুমাতে পারি না, ঘুমালেও সেটা ভাল ঘুম হয় না। কিন্তু ভোর-রাতে যেকোন জায়গায় চোখে কোত্থেকে জানি ঘুম চলে আসে, সে যত বড় ইনসমনিয়াকই হোক না কেন। গোয়া থেকে মুম্বাই আসছিলাম। ভোররাতে স্বপ্ন দেখছিলাম, আমার কাল্পনিক ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে ঘুরতে গেছি বোরা বোরা আইল্যান্ড। আমি নৌকা চালাচ্ছি, ডিঙ্গি নৌকা। নৌকার সামনে বসে ক্লিওপেট্রা হাত দিয়ে নীল পানি নাড়ছে আর হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে। হাসির শব্দ আমি মুখস্ত করে নেই। হয়ত বেশীদিন শুনতে পারব না।

বোরা বোরা আইল্যান্ডে ডিঙ্গি নৌকা আসার কথা না, কিন্তু আমার স্বপ্ন, আমি যা ইচ্ছা চালাব। দরকার হলে পানির উপর ট্রাক চালাব। একটু বেশী দুলুনি অনুভব করছি। নৌকার দুলুনি তো এরকম হবার কথা না। আবার পাশের ডিঙ্গি নৌকাটা হর্ন দিচ্ছে। হর্নের শব্দে আমি বাস্তবে ফিরে এলাম। পাশের বাসটা হর্ন দিচ্ছে।
ভোররাত, মুম্বাই পৌছানোর আগে কোথাও আমি পাহাড় দেখব একথা ভাবিনি। পরে ম্যাপে দেখেছি, জায়গাটার নাম লোনাভালা। কেউ একজন আকাশের পর্দাটা মাত্র সরানো শুরু করেছে। আমি অবাক হয়ে দেখি, দূরের অন্ধকার পাহাড়টা চোখের সামনে ভিজিএ ক্যামেরায় তোলা ছবি থেকে আস্তে আস্তে ডিএসএলআর-এ তোলা ছবি হয়ে যাচ্ছে। আমি বড় হয়েছি হবিগঞ্জে। ছোটবেলায় শ্রীমঙ্গল গিয়ে ছোট ছোট টিলা দেখে ভাবতাম, ওমা, কি বিশাল বড় পর্বত! এর উপরে উঠেই আমি এডমন্ড হিলারি হয়ে যাব। কিন্তু এখানে এত বড় পাহাড় দেখে নিজেকে হঠাৎ তুচ্ছ মনে হয়।
মুম্বাই পৌছানোর আগে নাভি মুম্বাই, বিশাল বড় বড় বিল্ডিং, প্রশস্ত রাস্তাঘাট। আমিও একটুও আকর্ষিত হইনি। আমার বরং পুরনো মুম্বাইয়ে ঢুকেই ভাল লাগে। মুখে বলি মুম্বাই, কিন্তু ফিলটা কাজ করে বোম্বের। আমি জানিনা কেন বোম্বে, মুম্বাই হয়ে গিয়েছিল। আগেই শুনেছিলাম, মুম্বাইয়ে ট্রাফিক অনেক বেশী থাকবে। আর এখানে এরা অসংখ্য ফ্লাইওভার বানিয়ে রেখেছে। আরেকটা ঢাকা শহরে আসলাম মনে হচ্ছিল।

বাসের হেল্পার জিজ্ঞেস করে আমরা কোথায় নামব। আমাদের বুক করা হোটেলের নাম ছিল গার্ডেন রেসিডেন্সি। কাছাকাছি একটা জায়গায় নেমে পড়ি। মুম্বাইয়ে চলার জন্য অটোরিক্সা ভাল, এটা আগে শুনেছিলাম। আমাদের এখানকার মত ১০ টাকা, ২০ টাকা বাড়িয়ে দিবেন এরকম কোন ব্যাপার নেই। ভাড়া যা আসবে তাই।

মুম্বাই – হোটেল বিড়ম্বনা

মহাকালী কেভ রোডের মাঝখানে একটা জায়গায় নামি ম্যাপ দেখে। আশেপাশে কোথাও গার্ডেন রেসিডেন্সি হোটেল খুঁজে পাই না। আরেকটু পিছনে গিয়ে অন্য আরেকটা রাস্তা দিয়ে ঢুকি। দেখি এক হাসপাতালে ঢুকে গেছি। ম্যাপে যে লোকেশান দেখাচ্ছে সেখানে একটা টিনের ঘর। গুগল ম্যাপ ধোঁকা দিচ্ছে আমাদের। লোকজনকে জিজ্ঞেস করি, হোটেল গার্ডেন রেসিডেন্সি কোথায়। প্রযুক্তিকে পাশে সরিয়ে রেখে, সেই প্রস্তর যুগের মত লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে অবশেষে হোটেল খুঁজে পাই।
হোটেল দেখে কিছুটা হতাশ হই। অনলাইনে বুক করা হয়েছে দেখেই এই অবস্থা। নাহলে দামাদামি করে অনেক কমানো যেত হয়ত। যাই হোক, রিসিপশনিস্ট আমাদের দেখে খুশী। বসতে বলল, বুকিং কনফার্মেশান মেইল দেখাতে বলল। অবশেষে আইডি দেখাতে বলল। যা ভেবেছিলাম তাই, পাসপোর্ট দেখেই হাসিখুশী চেহারা ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল।

বাংলাদেশী এলাউড না, সে আমাদের রাখতে পারবে না। আমি বললাম, কিন্তু আমরা তো পে করে ফেলেছি অলরেডি, বুক করার সময় তো বাংলাদেশী এলাউড না এরকম কিছু বলা ছিল না। এইসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য ভাষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমরা ঠিকমত হিন্দীতে কমিউনিকেট করতে পারছিলাম না, রিসিপশনিস্টও ইংলিশে ঠিকমত কমিউনিকেট করতে পারছিল না।

সে জানাল আমি চাইলে বাংলা বলতে পারি, সে বাংলা বুঝে। আমি তখন বাংলায় তাকে মানবিক বিষয়, অর্থনৈতিক বিষয় হেনতেন বুঝাতে চেষ্টা করি। একটা লাইন বলে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকি, আমার বাংলা বুঝতে পারছে কিনা বুঝার চেষ্টা করি। সে হিন্দীতে জবাব দেয়। খুব অদ্ভূত যোগাযোগ, আমি হিন্দী বুঝি, ভাল বলতে পারি না; সে বাংলা বুঝে, ভাল বলতে পারে না। আলম বাইরে বের হয়ে মেক মাই ট্রিপে ফোন দেয়, যেখান থেকে হোটেল বুক করা হয়েছিল।
এর মধ্যে রিসিপশনিস্ট আমাকে ভদ্রভাবে হোটেল থেকে বের হয়ে যেতে বলে। বাংলাদেশি থাকলে নাকি ঝামেলা হবে। আমি বললাম, যে ঝামেলাটা শেষ হওয়া পর্যন্ত বসি, সারারাত জার্নি করে এসেছি ভাই। কথায় চিড়া ভেজে না। মনে মনে বলছিলাম, হারামজাদা একদিন পলাশীর মোড়ে আয়, তোর কানের নিচে একটা লাগাব, তখন আর বাংলা-হিন্দী কোন ভাষাই বুঝবি না।

আমি আর আলম বের হয়ে রাস্তা পার হয়ে একটা দোকানের সামনে বসি। মেক মাই ট্রিপ, হোটেল মালিকের সাথে কথা বলে, সেও আমাদের রাখতে রাজি না। তারা কিছু একটা করবে বলে আশ্বস্ত করে। আমরা তখন মেকমাইট্রিপের কলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আমাদের ভার্সিটির আর্কিটেকচার ’১২ ব্যাচ এখন মুম্বাই। তারা কোথায় আছে জানার চেষ্টা করি। ছোটবোন মুকসেতু তখন মুম্বাই। জামালের কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে কল দেই ওরা মুম্বাই এ কোথায় উঠেছে জানার জন্য। সে ফোন ধরে না।

পরে দেশে আসার পর জানতে পারি ওরা একটা বাস ভাড়া করে ইন্ডিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বাংলাদেশী আছে দেখে ওদের বাস মুম্বাইয়ে ঢুকতে দেয়নি। ওরা বাস শহরের বাইরে রেখে মুম্বাই ঘুরে চলে গেছে। বাংলাদেশীরা মুম্বাইয়ে এতই অচ্ছুৎ! জামাল জানাল, মুম্বাইয়ে কোন হোটেলে যদি জায়গা না দেয়, সরাসরি যেন মসজিদে চলে যাই। এটা একটা ভাল বুদ্ধি।
অবশেষে মেকমাইট্রিপ থেকে কল আসল, তারা আমাদের জন্য কাছাকাছি আরেকটা হোটেল ম্যানেজ করে দিয়েছে। ওখানে বাংলাদেশী এলাউড, আমরা এখনি যেতে পারি। বিলের একটা মেইল আসল। হোটেলের ভাড়া ৮,০০০ রুপির মত। সব হারিয়ে বসে আছি, আগের হোটেল বুক করা হয়েছিল ২,০০০ রুপিতে। বাকী টাকা এখন কোথায় পাব? আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, আমাদের বাকী টাকা দিতে হবে, নাকি এটা মেকমাইট্রিপ থেকে সরি বলার একটা ওয়ে মাত্র।

আলম কল দিল, তারা জানাল আমাদের আর এক পয়সাও খরচ করতে হবে না। হোটেল রিগ্যাল টুঙ্গা, চার তারকা হোটেল, প্যাকেজে পরদিন সকালের জন্য কমপ্লিমেন্টারি ব্যুফে ব্রেকফাস্ট ইনক্লুডেড। হোটেলে যাবার পথে অটো ভাড়া আসল ২০ রুপি। ঢাকাতে সিএনজির সর্বনিম্ন ভাড়া ৪০ টাকা, কেউ কোন দিন ৪০ টাকা ভাড়া দিয়েছে?
প্রায় ১৪ ঘন্টা জার্নি করে এসেছি, সকালের এতসব ঝামেলার পরে চেহারার যে অবস্থা হয়েছে, তাতে আমাদের দেখে নিশ্চই মনে হচ্ছিল না আমরা ৪ স্টার হোটেলে থাকতে পারি। রিসিপশনে একটু এমেরিকান একসেন্ট ট্রাই করে, চেহারার দৈন্যতা ভাষা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা আরকি। জ্যুস অফার করা হয়, সেটাও কমপ্লিমেন্টারি ছিল, খেতে আরো বেশী ভাল লাগছিল।
রুমে ঢুকে প্রথম এক ঘন্টা কাজ ছিল এটা সেটা এক্সপ্লোর করা। গরিব মানুষ, কখনো এত ভাল হোটেলে থাকিনি। বিছানার এক পাশে দুনিয়ার সুইচ। একটা একটা করে ট্রাই করি। এখানে ওখানে লাইট জ্বলে উঠে, লাইট জ্বলে নিভে – জ্বলে নিভে। ছোট ফ্রিজ, ওভেন, চা-কফি বানানোর ব্যবস্থা, রুমের এক পাশে সব বিপ্লবীদের পছন্দের লোকজনের ছবি টানানো। চে, লেনিন, বব মার্লে। আমি বিছানার উপরে উঠে একটু বসে বসে লাফাই। আলম বলে কোন রুম সার্ভিস ব্যবহার করা যাবে না, ফ্রিজ থেকে কিছু খাওয়া যাবে না, নো লন্ড্রি, নো আদার সার্ভিসেস। এগুলোর যে চার্জ আসবে তাতে পরে প্যান্ট-শার্ট খুলে দিলেও লাভ হবে না।

শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢুকে আলম। একটু পরে পরে আওয়াজ আসে। “হেই ম্যান, গরম পানি আসছে,” “হেই ড্যুড, বাথ টাবের সাইডে একটা বাটন আছে, ঐটায় চাপলে এক পাশ থেকে পানি ছুটে আসে।” কাঁচের দরজার ভিতরে শাওয়ার নেয়ার উপায় ছিল সেটা সে খেয়ালই করে নাই। ফ্রী শেভার পেয়ে আমি শেভ করে বসি। লাইফের সবচেয়ে বড় তিনটা ভুলের মধ্যে একটা এটা ছিল। আমি বলছিলাম, কোন ছোটলোকি কাজ করা যাবে না। সানি লিওনিও নাকি একবার হোটেল থেকে টাওয়েল নিয়ে চলে গিয়েছিল। এখানে চিরুনি, ব্রাশ, টুথপেস্ট অনেক কিছুই আছে। সানি লিওনির মত কিছু করা যাবে না।

Hotel Tunga regal mumbai

অবশেষে থাকার জায়গা জুটেছে।

Hotel Tunga regal mumbai

হোটেল-রিসোর্ট কেমন তা জাজ করতে হবে এর ওয়াশরুম দিয়ে।

Mannat, Land’s end ( শাহরুখ খানের বাড়ি )

দুপুরে কোন মতে খেয়েই রওনা হই বান্দ্রার উদ্দেশ্যে। মুম্বাইয়ে কি দেখব তেমন কিছু ঠিক করে আসিনি। শাহরুখ খানের বাড়ী দেখব আর নারিমান পয়েন্ট যাব। অটোতে ডিরেক্ট শাহরুখের বাসার সামনে। বাসা চিনতে সমস্যা হয়নি। একটা বাসার সামনে অনেক মানুষের ভিড়। সেলফি তুলছে, আরেকজনের ছবি তুলে দিচ্ছে।

ছবি তোলার জন্য রীতিমত লাইনে দাঁড়ানো লেগেছে।

Mannat mumbai shahrukh khan house মান্নাত মুম্বাই

ছবি তোলার জন্য রীতিমত লাইনে দাঁড়ানো লেগেছে।

 

Mannat mumbai shahrukh khan house মান্নাত মুম্বাই

অবশেষে ছবি তুলে খুশী।

মান্নাত, বাসার পাশে আর সামনে উঁচু ঝাড়ের মত গাছপালা দিয়ে ঢাকা। ভিতরে দেখার কোন উপায় নেই। বাসার সামনে লেখা, MANNAT….. LANDs END. আসলেই ল্যান্ডস এন্ড। বাসার সামনেই সাগর, আরব সাগর। এরকম জায়গায় বাসা বানানো বলিউড স্টারদের পক্ষেই সম্ভব শুধু। যাই হোক, আমি কেন এসেছি এখানে জানি না। শাহরুখ খান আমার অত পছন্দও না, আমার পছন্দ সালমান খান।

এর পরে সালমান খানের বাড়ির সামনে যাব। খুব বেশী দূরে না, হেঁটেই রওনা হলাম। রাস্তার পাশে মার্সিডিজ, জাগুয়ার, বি এম ডব্লু এমনভাবে পরে আছে, যেন এগুলো মুড়ির টিন। একের পর এক মুড়ির টিন চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে, আর আমার চক্ষু বড় হয়ে যাচ্ছে। কিনব একসময় কোন একটা মুড়ির টিন।
সালমান খানের বাসা চিনতেও সমস্যা হয়নি। এই এলাকায় দুইটা বাসার সামনে লোকজন থাকে, একটা মান্নাত, আরেকটা গ্যালাক্সি এপার্টমেন্ট। সালমানের বাসা শাহরুখের বাসার মত না। পুরাই খোলা, আর দশটা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর মত। এজন্যই মনে হয় শাহরুখকে বাদশা বলে লোকজনকে, আর সালমানকে ভাই।
পরবর্তী গন্তব্য নারিমান পয়েন্ট, যেখানে মুন্না ভাই আর সার্কিট বসে থাকত। কিন্তু বান্দ্রা থেকে কোন অটো যায়না সেখানে, ঐটা আরো বড়লোক এলাকা, ট্যাক্সি নিতে হবে। আরেকটা গরীব উপায় আছে, লোকাল ট্রেন। বান্দ্রা স্টেশান থেকে চার্চগেট স্টেশান, ভাড়া বিশ রুপি। কোথায় নামতে হবে সেটা নিয়ে কোন টেনশান ছিল না। চার্চগেটই শেষ স্টেশান। লোকাল ট্রেন, বসার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু দাঁড়িয়ে যাওয়াটাকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে ওরা।

লোকজন খুব একটা ছিলনা তখন। আমি আরো ভেবেছিলাম আমাদের লোকাল বাসের মত হবে, মানুষের মাঝখানে সিদ্ধ হতে হতে যেতে হবে। ট্রেনের এক্সেলারেশান খুবই ভাল। প্রত্যেকটা স্টেশানে ট্রেন ১৩ সেকেন্ডের জন্য থামে। আমি ঘড়ি ধরে চেক করেছি, একেবারে ১৩ সেকেন্ড। তারপর নিমিষেই টপ স্পিডে উঠে যায়। চার্চগেট পৌছাতে আমাদের আধাঘন্টাও লাগেনি। অথচ এসেছি প্রায় ১৯ কিলোমিটার।

নারিমান পয়েন্ট, ম্যাকডোনাল্ডস সাথে স্টারবাকস

মুম্বাই আমাদের রিল্যাক্স করার জায়গা। মিউজিয়াম, পুরনো বিল্ডিং দেখে বেড়াব এরকম প্ল্যান ছিল না। আমাদের ট্যুরও প্রায় শেষের পথে। হাতে টাকা পয়সা কেমন আছে সেটা দেখে আলম বের করল যে আমরা দুই-একবেলা ম্যাকডোনাল্ডস ট্রাই করতে পারি। এখন আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত সাগরের পারে বসে থাকব। কোন বিচ নেই এখানে, কংক্রিটের ব্লক ফেলে রাখা হয়েছে সাগরের পাড়ে। তারপরে লোকজনের বসার জন্য সিট ওয়াল, হাঁটা-জগিং করার জন্য প্রশস্ত ফুটপাথ। সিট ওয়ালে বসে শহর দেখি। ইট-কনক্রিটের ব্লক। রাস্তা দিয়ে শুধু কার আর ট্যাক্সি যাচ্ছে। কারগুলো অধিকাংশই আগের মত মুড়ির টিন। এদের এত টাকা কেন! একটু বিকাল হলে, পেটে খিদা লেগেছে অনুভব করি। ম্যাপে ম্যাকডোনাল্ডস এর লোকেশান খুঁজে বের করি।
যা অনুমান করেছিলাম তার থেকে বেশ সস্তা এখানে খাবার। দুইজনের একটা প্যাকেজ ছিল, দুইটা করে বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আইসক্রিম আর আনলিমিটেড কোক – ৩৭০ রুপি। আমার আর আলমের মনে মনে একটা হাই ফাইভ হয়ে যায়। টেবিলগুলোর মাঝখানে ওয়্যারলেস চার্জার। লোকজন ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। খাবারটা মজা ছিল। পিছনে এক দল পোলাপান চিল্লাপাল্লা করছিল। টেবিলের উপর ওয়ান-টাইম গ্লাস সাজানো হয়েছে একটার উপর আরেকটা। পাতলা বেলুন ছুঁড়ে মারতে হবে একটু দূরে থেকে। একবারে যত বেশী সংখ্যক গ্লাস ফেলা যায়। আমার হাত নিশপিশ করছিল বেলুন ছুঁড়ার জন্য। কিন্তু, ঐ পোলাপানের মাঝখানে গিয়ে কি বলব, তার চেয়ে আমি আরেক গ্লাস কোক নিয়ে আসি।
ম্যাকডোনাল্ডসের পাশেই স্টারবাকস। ভাবলাম, এতদিন গরিবী হালে চলেছি। একদিন একটু বড়লোকি দেখানোই যায়। স্টারবাকস এর কফি খেয়ে আসি, শুনেছি দাম কম।
Cappuccino, Americano, Espresso, Mocha কোনটা কিভাবে বানায় আমি জানতাম, কিন্তু তখন ভুলে গেছি। এইধরনের জ্ঞানের কোন মানে নেই আসলে, দরকারের সময় কাজে না আসলে। আমি সেইফ থাকি বাবা, Cappuccino খাই; আলম Mocha খাবে। কাপের গায়ে আমাদের নাম লিখে নিল। ওয়েল, আমি হতাশ ছিলাম। কারণ, কফি অত ভাল না।

Starbucks mumbai স্টারবাক্স মুম্বাই

At Starbucks. Ignore my shaved face.

আবার নারিমান পয়েন্টে এসে বসে থাকি। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। বিল্ডিংগুলোর গায়ে এখন বাতি জ্বলছে, বাতাস একটু বেশী। অনেক টাকা দরকার ম্যান, আলম বলল। এই ট্যুরে এসে এই জিনিস বুঝলাম। আমি বললাম, আরেকটা জিনিস বুঝেছি, আমি কি চাই সেটা বুঝেছি; হাল ছাড়ব না ম্যান। দুই বন্ধুর ফিলোসফিকাল কথা বার্তার মাঝখানে দুই একটা ঢেউ এসে ভেঙ্গে পরে কংক্রিটের ব্লকের মধ্যে। পাশে বসে থাকা অভিমান করা প্রেমিকা কথা বলে না, প্রেমিক হয়ত লক্ষ্মী সোনা— চাঁদের কণা বলার চেষ্টা করছে। পিছনে ভুঁড়িওয়ালা আংকেল ঘামে ভিজে গেছে, কিন্তু দৌড় থামাচ্ছে না। আজকেই ভুঁড়ি অর্ধেক কমিয়ে ফেলবে। আকাশে তারা ছিল অনেক। আমাদের সামনে শুধু সাগর, আরব সাগর। সোজাসোজি ওইপাড়ে ওমান। হয়ত কোন মোহাম্মদ অথবা রাবেয়া সাগর পাড়ে বসে পা ভিজাচ্ছে। আকাশে চাঁদ দেখছে, ওইখানের আকাশেও কি এত গুলো তারা?

ইন্ডিয়ার এর অন্য লেখা গুলো

কাচ, সাগর যেখানে শুকিয়ে যায়

লেখা পড়ে ভালো লাগলে শেয়ার বাটনে ক্লিক করে শেয়ার করুন

পরবর্তী লেখা গুলোর আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।