পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ

থিম্পু থেকে পুনাখা

থিম্পু

থিম্পু তে ট্যাক্সি থেকে নেমে আমরা বাংলা স্টাইলে রাস্তা পার হওয়া শুরু করলাম। সাথে সাথে বাঁশি মারতে মারতে এক পুলিশ দৌড়ায় আসল। বলল আমরা যাতে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হই। শুনে পুরা টাস্কি খেয়ে গেলাম। কারণ রাস্তা মুটামুটি খালি। আর জেব্রা ক্রসিং নামে এক জিনিস ছোট বেলায় বইতে পড়েছিলাম, এইটা যে আদৌ দুনিয়াতে আছে এবং মানুষ ব্যাবহার করে, তা তো আগে বুঝি নাই। পরে দেখলাম, রাস্তা যতই খালি থাকুক, আর আশে পাশে পুলিশ থাকুক বা না থাকুক, কেউ জেব্রা ক্রসিং ছাড়া রাস্তা পার হয় না। দেখে জাতিটার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। আর লাগল আফসোস। আমি জানি না দুনিয়ার আর কোন দেশে কেউ আমাদের মতো কেয়ারলেসলি রাস্তা পার হয় কিনা।
কিছুক্ষণ হেটে একটা জুতসই হোটেল খুঁজে বের করে আমি ধাপ করে শুয়ে পড়লাম। আজ এমনিতেই সারাদিনের ট্রেকিং আর জার্নিতে শরীর অনেক ক্লান্ত। সাব্বির ভাই বের হয়ে গেল আশে পাশে ঘুরে দেখতে, আর ডলার ভাঙ্গানো যায় কিনা তার খোজ নিতে।
কিছুক্ষণ পর দেখি সাব্বির ভাই হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে বললেন যে যাতে তাকে আট হাজার টাকা দেই। ট্যুরের আনঅফিসিয়াল ম্যানেজার হিসেবে আমি কাজ করছিলাম, তাই সব টাকা আমার কাছে ছিল। উনি নাকি কোথায় অরিজিনাল চামড়ার একটা জ্যাকেট দেখে আসছে, যেইটা দেশে জীবনেও পাওয়া যাবে না, সেটা কিনতে চায়। আর বললেন দরকার হলে দেশে ফিরে রিক্সা টেনে হলেও আমার টাকা এক মাসের মধ্যে শোধ করে দিবেন। এরপর তো আর না দিয়ে পারা যায় না, দিয়ে দিলাম। সাথে এক হাজার টাকা বেশি দিলাম ইমার্জেন্সির জন্য। তো উনি আট হাজার টাকায় এক জ্যাকেট আর সাথে এক হাজার টাকায় এক মানিব্যাগ কিনে এনে দাঁত কেলায় হাসতে থাকলেন। আর বলতে লাগলেন, ‘ভাই, চিন্তা কইরেন না, দেশে ফিরে রিক্সা ……’।
পরের দিনের প্ল্যান নিয়ে আমরা দুইজনই খুব এক্সাইটেড। থিম্পু থেকে রয়েল এনফিল্ড ভাড়া নিয়ে পুনাখা যাব। গুগল করে একটা সার্ভিস পেয়েছিলাম যারা বাইক ভাড়া দেয়, ‘Bhutan Tusk Motorcycle’। তাদের ফোন দিলাম, কিন্তু কেও ধরেনা। ভাবলাম সাপ্তাহিক ছুটি দেখে হয়ত অফিসে কেও নাই।
পরদিন সকালে গাট্টি বোসকা প্যাক করে চলে গেলাম থিম্পু ইমিগ্রেশন অফিসে। সেখান থেকে পুনাখা যাবার পারমিট নিতে হবে। যেয়ে পরলাম বিপদে, পাসপোর্টের ফটোকপি চায়। ফটোকপি ত নাই। এতো সকালে কোন দোকানও খুলে নাই যে করায় নিব। একদম সেম বিপদে পড়েছিলাম লাস্ট ইন্ডিয়া ট্যুরে, রন অফ কাচ এ যেয়ে। ভুটানে ধরা খেয়েও আমার শিক্ষা হয় নাই। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা, যে মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম সেবার।
ঠিক হল সাব্বির ভাই অপেক্ষা করবেন অথবা খুঁজাখুঁজি করবেন আশেপাশে, ফটোকপি করার জন্য, আর আমি যাব বাইক ঠিক করতে। আজকে সকালে যেয়ে বিকালে চলে আসার প্ল্যান, তাই দেরি করা যাবে না। গুগল ম্যাপ এর দেখানো পথ ধরে হাটতে থাকলাম। এবার আর জেব্রা ক্রসিং ভুল করলাম না।
বাইক রেন্টালের অফিস দেখলাম একটা শপিং সেন্টারের ভেতরে। সকাল দেখে সেটাও বন্ধ। আশে পাশে কোন বাইকও দেখলাম না। সন্দেহ হতে লাগলো ঠিক জায়গায় এসেছি কিনা। এবার তাদের নাম্বারে কল দেয়ার পর একজন ধরল আর বলল যে বিল্ডিং এর পেছনে চলে আসতে।
সেখানে আমার খান্দু’র সাথে প্রথম দেখা। সেই এই বাইক রেন্টাল চালায়। জানলাম যে তারা একদিনের জন্য বাইক ভাড়া দেয় না, আর সাধারণত গ্রুপে ভাড়া দেয়। আমাদের মতো সিঙ্গেল বাইক কেও নেয় না। ভয় হতে লাগল, এতো আশা করে এসে শেষে না আবার ট্যাক্সিতেই যাওয়া লাগে। আমার চেহারা দেখে তার মনে হয় মায়া হল। বলল যে চলেন, কখনো কাওকে এইভাবে দেই না, তাও পাশের দেশ থেকে আসছেন, আর এখন বাইক ট্যুরের সিজনও না। বাইক গুলো পরেই আছে, তাই দিলাম। আমি নাকি গত তিন মাসে প্রথম কাস্টমার।
সে বাইক রাখে থিম্পু শহর থেকে একটু বাইরে, তার বাসার সামনে। তার গাড়িতে উঠতে বলল, সে ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে। ইতোমধ্যে সাব্বির ভাই পারমিট রেডি করে ফেলেছে, তাকে ফোন দিয়ে বললাম, আমাদের হোটেলের সামনে যেয়ে দাড়াতে, বাইক আসতেছে।
গাড়ি যেখানে যেয়ে থামল, সেখানে দেখলাম কতগুলো বাইক ঢেকে রাখা, ধুলার আস্তরণ পরে আছে কাভারের উপর। মন খারাপ হয়ে গেল, ভাবলাম পুরাতন একটা বাইক বের করে দিবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে কাভারের নীচ থেকে বের হল, ২০১৫ মডেলের থান্ডারবার্ড ৫০০। ৫০০ সিসির বাইক। কন্ডিশনও অনেক ভালো। ঢাকায় চালাই ১০০ সিসির চাইনিজ বাইক, প্রথমবারের মতো পাঁচশ সিসির বাইক চালাবো ভেবে উত্তেজনায় লাফাতে লাগলাম। বাইক ঝেরেমুছে পরিষ্কার করা হল। আমি বললাম যে ৫ মিনিট একটু টেস্ট রাইড করতে চাই। বাইক অনেক ভারী, প্রথম ২ মিনিট চালাতে অনেক সমস্যা হলো। কিন্তু আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। তারপর খান্দুর গাড়ির পিছন পিছন রওয়ানা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্য, কারণ ডলার সব সাব্বির ভাই এর কাছে।
বাইক নিয়ে যখন থিম্পু শহরে ঢুকছিলাম, নিজের মাঝে একটা গ্যাংস্টার ফিলিংস কাজ করছিল। আর ইঞ্জিনের সাউন্ডের কথা নাই বলি। সাউন্ড দিয়েই সবাইকে জানান দিয়ে  দেয় যে আমি আসতেছি। রাস্তায় অনেকেই তাকায় থাকে বাইক দেখার জন্য, ফিলিংস ই আলাদা। বাইকের ভাড়ার টাকা পয়সা আর গাড়ির কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে আমরা শুরু করলাম আমাদের বাইক রাইড।
বাইক দেবার সময় খান্দু সাহেব বলে দিয়েছিল যে জেব্রাক্রসিং দেখলেই যাতে বাইক স্লো করি, কেও থাকুক বা না থাকুক। আর আমাদের এখানে, মানুষ তো দূরে থাক, হাতি ঘোড়া দেখলেও তো মনে হয় না কেও গাড়ি স্লো করে। আমরা যখন গিয়েছিলাম, তখন শীতকাল শুরু হবে হবে করছে। রাস্তায় রাতের বেলায় বরফ জমে থাকে। আর যাবার সময় আমাদের ‘দচু লা’ নামে একটা পাস পার হয়ে যেতে হবে। খান্দু বলে দিল যে পাসের আশে পাশে বরফ থাকতে পারে রাস্তায়, বরফ দেখলে যাতে স্লো করে দেই, তা নাহলে ঢালু রাস্তায় নামার সময় চাকা স্লিপ করতে পারে। আমি বললাম তথাস্তু।
সে আমাদের বাইক তো ঠিকই দিয়া দিল, কিন্তু কোন তালা দিল না। আমি জিজ্ঞাস করলাম, তালা কই? বাইক রেখে দূরে গেলে কিভাবে যাব। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলে, যেখানে মনে চায় বাইক রাইখা চলে যাইতে, কেও নাকি নিবেনা। আমি ভাবলাম আজিব দেশ, কেও মনে হয় জানেও না যে চাইলে সে আরেকজনের জিনিস না বলে নিয়ে চলে যাইতে পারে (যেমন গুজরাটে বাসে একজন আমার ডিএসএলার তার মনে করে নিয়েচলে গিয়েছিল) ।
সাব্বির ভাইকে বানানো হল নেভিগেটর কাম ক্যামেরাম্যান, উনি পিছনে বসে ম্যাপ দেখে দেখে আমাকে রাস্তা বলে দিবেন। সাথে সেলফি স্টিকে লাগানো গো প্রো দিয়ে ভিডিও করবেন। থিম্পু শহর থেকে বের হয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে উপরে উঠতে থাকলাম।
এরকম সুন্দর টেরাইনে বাইক নিয়ে ট্রিপ দেয়ার ফিলিংস আসলে লিখে প্রকাশ করার সম্ভব না। আকাশ ছিল পরিষ্কার, আর ঝক ঝকে রোদ। তাই অনেক দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এই রোদও শীতের তীব্রতা কমাতে পারছিল না। তাই হাতে মোটা গ্লাভস থাকার পরেও ঠাণ্ডায় হাত অবশ হয়ে যাচ্ছিল।
এদিকে, টাইগার্স নেস্ট এ সাব্বির ভাই কুকুর নিয়ে নাচানাচি করার এক পর্যায় তার গ্লাভসে কুকুর ইয়ে করে দেয়। তাই অই গ্লাভস ফেলে দিয়ে এক হাতে গ্লাভস পরে বসে আছেন। আরক হাত খোলা। তার গায়ে গতকাল রাতে কিনা আট হাজার টাকার জ্যাকেট।
ঐ জ্যাকেট পরে পার্ট নিয়ে ছবি তোলা যায়, কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে বাইক রাইড দেয়া যায় না। ফলশ্রুতিতে উনি ঠাণ্ডায় কাপতে থাকলেন। ঘন্টাখানেক পরে পোঁছে যাই দচুলা। আমাদের রুটের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা। সেখান থেকে ইস্টার্ন হিমালয়া রিজিওনের সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়।

 

Dochula pass bhutan, দ চু লা, দচুলা, পুনাখা, ভুটান

দচুলা, পিছনে হিমালয়ান রেঞ্জ। সাথে রয়েল এনফিল্ড থান্ডারবার্ড

দচুলায় যেয়ে কথা হল এক বাঙালি পরিবারের সাথে। তারা পুরো একটা মাইক্রো ভাড়া করে চলে এসেছে। ইন্ডিয়ান দের ভুটানে ঢুকতে কোন পাসপোর্ট ভিসার প্রয়োজন হয় না। জানলাম তারা বাচ্চা কাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র চার পাঁচ দিনের জন্য ঘুরতে বের হয়ে যায়। অনেকে বাচ্চা কাচ্চা হলে ঘুরাঘুরি বন্ধ হয়ে যায়। তাদের জন্য এই পরিবার একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে।

Dochula pass bhutan, দ চু লা, দচুলা, পুনাখা, ভুটান

আট হাজার টাকার জ্যাকেট পরা ভাই, হাতে গ্লাভস দুইটা আমার

দচুলার পরে অনেকটা রাস্তা ভাঙ্গা, আসলে রাস্তার কাজ চলছে। মাঝে মাঝে এই ভাঙ্গা রাস্তা গুলো ছাড়া বাকি অংশ রাস্তা অনেক ভালো। তাদের এই রাস্তা রেগুলার মেইনটেইন করতে হয়। কারণ এই রাস্তায় ফ্রিকোয়েন্টলি পাহাড় ধস হয়। যাবার সময় দেখছিলাম পাশের পাহাড় থেকে বিশাল বড় বড় পাথর বা মাটির দলা এসে পড়ে আছে। এজন্য রাস্তার একদম কিনার দিয়ে চলানো ও ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ যেকোনো সময় কিনার ধসে পরে যেতে পারে।
কিছু যায়গায় এইরকম রাস্তা ভেঙে পড়ে গেছে দেখলাম, সেখানে পাথর দিয়ে মার্ক করে দেয়া, অনেক যায়াগায় চক দিয়ে মার্ক করা থাকে যাতে কেও অদিকে না যায়।একটা বিশাল কন্সট্রাকশন ভেহিকেল দেখলাম, তার পিছনে লেখা – ‘Hell was full, so I came back’।
একটু পর পর রাস্তায় একশ আশি ডিগ্রী বাক। বাইকের গিয়ার ৩ থেকে ৪ এ তুলতে না তুলতেই নামায় দিতে হয়। আর এতো ভারী বাইক মোড় নেয়ার সময় অনেকটা হেলে যেতে হয়। এইরকমই এক মোড় নেয়ার সময় খেয়াল করলাম বাইক হেলানো যাচ্ছে না, তাই মোড় ও নেয়া যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি ব্রেক ধরলাম। দেখি পিছনে আমার ফটোগ্রাফার হাতে ক্যমেরা নিয়ে, আমি যেদিকে মোড় নিব তার উলটা দিকে কাত হয়ে, পারলে চাকার নীচে যেয়ে ভিডিও করতেছেন।
thimpu to punkaha road পুনাখা থিম্পু

পুরো রাস্তাই অলমোস্ট এইরকম ছিল

ভুটানিজ দের আরেকটা জিনিস আমার ভালো লাগল, তাদের ট্রাফিক রুল মেনে চলা। প্রায় নব্বই কিলো ড্রাইভ করলাম, দুই মিনিট পর পরই বাক নেয়া লাগছিল, কিন্তু একটা বারো হর্ন দেয়া লাগে নাই। কারণ অপর পাশ থেকে যে গাড়ি আসে সে কখনই তার লেনের বাইরে যায় না। আর আমি ঢাকা থেকে সাজেক যখন বাইক নিয়ে গিয়েছিলাম, হর্ন দিতে দিতে আমার বাইকের ব্যাটারি ডাউন হয়ে গিয়েছিল।

শুধু তাই না, আমি যদি অন্য কোন ট্রাক বা গাড়িকে অভারটেক করার চেষ্টা করিয়ার উলটা পাশ থেকে কোন গাড়ি আস্তে থাকে, তখন যাকে ওভারটেক করতে চাচ্ছি সে সিগনাল দিয়ে বলে দেয় ওভারটেক না করতে।

পুনাখা

পুনাখা তে আমার আমার দেখার ইচ্ছা তাদের সাসপেনশন ব্রিজ।পুনাখাতে নদীর উপর, এ পার থেকে ওপার পর্যন্ত কেবল দিয়ে ঝুলন্ত এক ব্রিজ। পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে দেখা গেল নদীটা। পানির কালার দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ঠিক নীল ও না, আবার সবুজ ও না, মাঝামাঝি একটা কালার। আর কাচের মতো স্বচ্ছ পানি। এই নদীর ধার ঘেঁষে মিনিট দশেক পর আমরা পৌঁছলাম ব্রিজের পাশে।
জায়গাটা এতো নীরব আর সুন্দর, যে আমার মন উদাস হয়ে গেল। এখানে একা একা বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেয়া যায়। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকার উপায় নেই, সূর্য ডুবার আগেই থিম্পু পৌছাতে হবে। অন্ধকারে পাহাড়ি রাস্তায় ড্রাইভ করতে চাই না
punakha bhutan

পুনাখা ভুটান

punakha suspension bridge পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ ভুটান

সাস্পেনশন ব্রিজে পার্ট নিচ্ছেন ভাই, সাথে আট হাজার টাকার জ্যাকেট

দুপুরে খেতে যেয়ে দেখি কোন রেস্টুরেন্ট নাই। অনেক খুঁজা খুঁজি করে একটা পেলাম। সাব্বির ভাই যথারীতি লাল পানীয় দামাদামি করতে লাগলেন। দোকানে একটা পিচ্চি, সে দেখি ভাই কে সাজেস্ট করতেসে, যে এইটা না, ওইটা খান। এইটার এই সুবিধা। আমাদের দেশে এই কাজ হলে তো সবাই হা রে রে করে তেড়ে আসত, যে ছেলে নষ্ট হয়ে গ্যাসে। ভুটানে জিনিসটা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের এখানে যেমন কোক বিক্রি হয় সব দোকানে, তাদের ওখানে বিয়ার। যে ঠাণ্ডা পড়ে শীতকালে, বিয়ার ছাড়া উপায় নাই।
পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ, পুনাখা, ভুটান

বাইক নিয়ে পার্ট নিচ্ছেন ভাই, সাথে যথারীতি আট হাজার টাকার জ্যাকেট

বিল দেয়ার সময় দেখি এক প্লেট ভাত ৬০ রুপি আর মুরগি ২০ রুপি। আমি আর সাব্বির ভাই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলাম। ভুল করে এই দাম লিখসে, নাকি অন্য কিছু লিখসে আমরা ভুল করে এই দাম পড়ছি বুঝতে পারলাম না। পরে জানলাম এই পাহাড়ি এলাকায় ধান চাষ করা অনেক কঠিন, তাই উৎপাদন খরচও বেশি, তাই দামের এই বৈষম্য।
বিকাল হয়ে আসছে, তাই তাড়াতাড়ি রওয়ানা দিলাম থিম্পুর উদ্দেশ্যে। সূর্য ফুল তেজে থাকা অবস্থাতেই ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলাম, এখন তো বিকাল, ঠাণ্ডায় দাঁত কপাটি বাড়ি লাগতে থাকল। আর আমার পিছনে একতা হাতমোজা পড়া সাব্বির ভাই তার হাত গরম রাখার জন্য, হাত কোথায় ঢুকায় রাখল তা আর নাই বা বললাম।
তাড়াতাড়ি যাবার জন্য বাইক পাহাড়ি রাস্তায় আশি নব্বই তে টানতে লাগলাম। দচুলা পাস পর্যন্ত পোছাতে পৌছাতে মনে হল যে অনন্ত কাল লেগে গেল। ততক্ষণে আমার হাত শেষ। কেও কেটে ফেললেও বোধহয় টের পেতাম না। আমি যে ক্লাচ, ব্রেক ধরব, হাতে কিছু টের পাই না। বাম হাতে চাপ মারার মত চেষ্টা করি, বাইকের ইঞ্জিনের সাউন্ড শুনে বুঝি যে ক্লাচে চাপ পড়সে। আট হাজার টাকার জ্যাকেট সাব্বির ভাই কে এখানে ভালোমতোই ধোঁকা দিল। উনি কাপতে থাকলেন। কাপতে কাপতে মনে হল যেন অনন্তকাল পর আমরা দূরে থিম্পু শহরের আলো দেখতে পেলাম।

আবার থিম্পু

খান্দু সাহেবের বলা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সাব্বির ভাই এর হাত ততক্ষণে স্বাভাবিক অবস্থায় এসেছে। ওনার তখন শখ হল বাইকে বসে একটু ঠেলা ঠেলি করবে। তো বসার পর বাইকের ভারের কারণে আর বাইক সোজা করতে পারেন না। দিনে ১০০ টা বুকডন মেরে তার কি লাভ হল বুঝলাম না।
খান্দু সাহেবের পিছনে যেয়ে গাড়ি ফেরত দিয়ে আসলাম। অবাক হলাম যে সে একবার চেক ও করল না যে বাইকের সব ঠিক ঠাক আছে কিনা, জাস্ট নিয়ে গ্যেরেজে রেখে দিল। তারপর বল্যে গাড়িতে উঠতে, সে আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিবে। ড্রাইভিং সিটের পাশে ছিল তার বৌ, নাম মনে নাই। সে সরকারি চাকরি করে, ভুটান এর নদী মন্ত্রণালয়ে। একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি যে আপনাদের বিসিএস এ কি প্রশ্ন করে 😛 ।
থিম্পু তে বুদ্ধ পয়েন্ট নাম এ সুন্দর একটা মন্দির আছে, যেটা শহরের পাশেই একটা পাহাড়ের একদম উপরে। প্লেন ছিল যে সন্ধ্যার আগে চলে এসে বুদ্ধ পয়েন্ট যাব। কিন্তু আসতে আসতে রাত হয়ে গেল, আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, তাই আর যাওয়া হলো না। কালকেই চলে যেতে হবে, তাই থিম্পু শহরটা ঠিক মতো দেখা হবে না ভেবে মন খারাপ হচ্ছিল।
গাড়ি যেতে যেতে খান্দূ ভাই এর সাথে গল্প হচ্ছিল, উনি শুনালেন যৌবনকালে কিভাবে উনি দুনিয়ার সব যায়গায় বাইক নিয়ে রাইড দিয়ে বেড়িয়েছেন। এরপর শুরু করেছেন এর বাইক হায়ারের ব্যবসা, যেটা তার কাছে ব্যবসার চেয়ে শখ বেশি। তার বিভিন্ন বাইক রাইডের কাহিনী শুনলাম।
একটু পর একতা রাস্তা দেখিয়ে বললেন যে, এদিক দিয়ে গেলে বুদ্ধ পয়েন্ট যাওয়া যায়। আমরা গিয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করল। যাইনি শুনে বলল যে, যেতে চাই কিনা, তাহলে সে নিয়ে যাবে। যাওয়ার ইচ্ছা তো আছে ষোলআনা, কিন্তু তাকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করল না। তার উপর তার সাথে তার বৌ ও আছে। কিন্তু সে এসব শুনে বলল, আরে ধুর, চল নিয়ে যাই, এইগুলা কোন সমস্যাই নাই। তখন থেকে আমার আর সাব্বির ভাই এর অবাক হওয়ার পালা শুরু।
খাড়া পাহাড় বেয়ে অনেকটা উপরে উঠে যেতে হয়ে বুদ্ধ পয়েন্ট যাবার জন্য। রাতে গিয়েছিলাম, দেখি আশে পাশে কেও নাই, শুধ আমরা। খান্দু বলল যতক্ষণ মনে চায় থাকতে কোন সমস্যা নাই। থাকব কি, ঠাণ্ডায় হাত পা বরফ হয়ে যাবার যোগার। তার উপর পাহাড়ের টপে হবার কারণে প্রচণ্ড বাতাস। সেখান থেকে পুরো থিম্পু শহরের একটা প্যনারোমিক ভিউ পাওয়া যায়। ঠাণ্ডায় কোন এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়ানো দায়, শরীর গরম রাখার জন্য দুইজন তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছি।
বুদ্ধ পয়েন্ট থিম্পু, Buddha point thimpu

বুদ্ধ পয়েন্ট, আমরা ছাড়া আর কেও ছিল না

এর মাঝে হটাত দুই জন আমাদের স্থানীয় ভাষায় কিছু বলতে লাগল।তারা কিছু একটা বলে, আমি ইংলিশ এ বলি হোয়াট, হিন্দি তে বলি ক্যায়া। কিন্তু সে ইংলিশ আর হিন্দি কিছু বুঝল বলে মনে হল না। তার ভাষায় কিছু একটা বলে যাচ্ছে। অনেক ইশারা ইঙ্গিত দেয়ার পর বুঝলাম যে রাতে এখানে গাড়ি রাখা যাবে না। আমরা এমনিতেও তখন চলে যেতাম। তাদের বললাম যে সমস্যা নাই, এখনি চলে যাচ্ছি।
খান্দু ভাই যখন শুনল যে থিম্পু কিছুই ঘুরি নাই, আর না ঘুরেই কাল চলে যাচ্ছি, বলল যে সেই আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবে। আমি আর সাব্বির ভাই একজন আরেকজনের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলাম, যে পরে যদি টাকা চাইয়া বসে। আমাদের মনে হয় খান্দু আমাদের মনের কথা বুঝতে পারল, সে বলল চাপ নেয়ার কিছু নাই। এইটা ফ্রি রাইড, তার আমাদের ভালো লাগসে, তাই সে আমাদের নিয়া ঘুরতে বাইর হইসে। অনেক লজ্জা পেলাম শুনে। আসলে এমন এক পরিবেশে থাকি, মন মানসিকতা অটোমেটিক নিচু হয়ে গেছে।
খান্দু আমাদের পুরো ভুটান শহরের চারিদিক দিয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে ট্যুর দিয়ে বেড়াল। মাঝে একবার গাড়ি এমন এক যায়গায় দার করাল যেখান থেকে পুরো থিম্পু শহর দেখা যায়। আমাদের জিজ্ঞেস করল, বল তো রাজার বাড়ি কোনটা? একটা বড় বাড়ি দেখা যাচ্ছিল যাতে অনেক লাইটিং করা। স্বাভাবিক ভাবেই বললাম যে ঐটা। আসলে ঐ বাড়ির পাশে একটা অন্ধকার মতন যায়গা আছে, সেটা হল রাজার বাড়ি। তাদের রাজা জাঁকজমক পছন্দ করে না। সাদাসিধে জীবন যাপন করে। এখন আর এসব শুনে অবাক হই না। বুঝে গেছি যে এই দেশের সব লোকই এমন, একটু বেশি ভালো।
Thimpu bhutan

খান্দুর সাথে আমি, পিছনে বড় বিল্ডিং টার ডান দিকে অন্ধকার মতন জায়গাটা তে রাজার বাড়

তারপর সে আমাদের নিয়ে গেল ‘Walking Buddha’ দেখাতে। একটা পার্কে ৪৫ ফিট উঁচু বুদ্ধের মূর্তি। ২০১২ সালে এইটা স্থাপন করা হয় থাইল্যান্ড এর রাজার জন্মদিন উপলক্ষে। থাইল্যান্ড এর রাজার জন্মদিনের জন্য ভুটানে কেন মূর্তি বসাবে, আর সেইটারে ‘হাটা বুদ্ধ’ কেন বলবে মাথায় ঢুকল না।আরও কয়েকটা যায়গা ঘুরে দেখানোর পর তাকে আমাদের সাথে খাবার জন্য অনুরোধ করলাম। বাসায় বাচ্চারা আছে বলে ভদ্র ভাবে না করে দিল। তবে বলল ঢাকায় যদি কখনো আসে, তখন অবশ্যই এই খাওয়া আদায় করে নিবে। সে নাকি আগেও একবার ঢাকা এসেছিল। তখন খুব পেইন খেয়ে গেসে। আমি ভাবলাম যে নিশ্চয়ই জ্যামের কারণে। আসল কারণ অন্য, সে ঢাকায় এসে কোথাও বিয়ার খুঁজে পায় না। যারা সকাল বিকাল ভাতের সাথে বিয়ার খায়, তাদের জন্য ব্যাপারটা তো কষ্টের বটেই।
খান্দুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। তার একটা কথা খুব ভালো লেগেছিল, ‘আমার কাছে সবাই আসে কাস্টমার হিসাবে, ফিরে যায় ভাই হিসাবে’। আসলেই তাই, তার সাথে এখনো যোগাযোগ আছে। আমার নেক্সট ইন্ডিয়া ট্যুরের ব্যাপারে সে অনেক সাহায্যও করছে।
পরের দিন সকালে আমরা থিম্পু থেকে পারো চলে যাই, আমাদের প্লেন ছিল দুপুরে। এইদিন আর কিছু করা হয় নাই। সকাল বেলাতেও খান্দু ফোন দিয়ে খোজ নিল যে আমরা ঠিক ঠাক মতো এয়ারপোর্ট গিয়েছি কিনা। ভুটানে এসেছিলাম পাহাড় দেখতে, কিন্তু প্রকৃতির চেয়েও বেশি সুন্দর এই দেশের মানুষের মন। গুটিবাজি বলে কিছু যে আছে তা বোধহয় এই এলাকার লোকজন জানেই না। ট্যাক্সি তে বসে ফেরার পথে মাথায় শুধু এগুলোই ঘুরছিল । শুধু মাত্র ভুটানের মানুষ গুলোর সাথে পরিচিত হবার জন্যে হলেও একবার ভুটান আসা উচিত

ভুটানের অন্য লেখা গুলো

লেখা ভালো লাগলে নিচের শেয়ার বাটনে ক্লিক করে শেয়ার করুন
পরবর্তী লেখা গুলোর আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।