Annapurna Base Camp

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প( ৪১৩০ মিঃ )

‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ শব্দটা আমরা ব্যাবহার করি যখন কোনও জিনিসের সৌন্দর্য আমাদের কল্পনার মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। এইদিন সকালে বাহিরের ভিউকে বর্ণনা করার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনও শব্দ আমার জানা নাই। দূরে মেঘের ফাঁকে অন্নপূর্ণা ১ এর পিক এর একটা অংশ দেখা যাচ্ছে, তার উপর জমে থাকা বরফে রোদ পড়ে জ্বল জ্বল করছিল। বন্ধু জ্যোতি মানালি তে এরকমই একটা মুহূর্ত দেখে লিখেছিল এরকম – ‘দেখে মনে হয় যাতে অন্ধ হয়ে যাই, এ চোখ এর চেয়ে সুন্দর কিছু আর দেখতে চায় না’। সেদিন এই কথার মর্ম অনুভব করতে পারি নাই, আজ পারলাম।
আশে পাশে সবাই পাহাড়ের চূড়া দেখে খুশিতে চিৎকার চেঁচামেচি আর ছবি তুলতে ব্যস্ত, আমি এসব না করে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম, চাচ্ছিলাম মন ভরে দেখে নিতে। কিছুক্ষণ পর নোমান এসে জয়েন করল, কিছু ছবি তুললাম। ছবি গুলো দেখে আমার একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসল, যা দেখা যাচ্ছে সেই সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও ছবি দেখে বোঝা সম্ভব না।  এসবের টানেই সবাই এতো দূর দূরান্ত থেকে, এতো পরিশ্রম করে ছুটে আসে , নিজের চোখে দেখার জন্য। এই কয়দিনের করা সব পরিশ্রম, সব কষ্ট ধুয়ে মুছে গেল।
আজকাল অনেক সুন্দর জায়গায় বিল্ডিং টিল্ডিং তুলে, ভালো ফ্যাসিলিটি দিয়ে অনেক টুরিস্ট স্পটকে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যাবহার করা হয়। কিন্তু প্রকৃতিকে আমার মতে প্রকৃতির কাছে তার মতো করেই দেখা উচিত, তাকে আমাদের বশে এনে নয়। আরও ৩০ মিনিট চুপ চাপ দাঁড়িয়ে মুহূর্ত টা উপভোগ করলাম, জানি আর একটু পরেই ফেরার পথ ধরতে হবে, তাই যতটা সম্ভব স্মৃতিতে গেঁথে নিচ্ছিলাম।
আমাদের ভাগ্যটা অনেক খারাপ ছিল, তাই মেঘের জন্য অন্নপূর্ণা রেঞ্জের অনেকগুলো পাহাড়ই দেখতে পাই নাই। তাও ভালো , যারা আমাদের আগের দিন এসেছিল তাদের কাছে শুনেছিলাম যে তারা কিছুই দেখতে পায় নাই। সবগুলো পাহাড় একসাথে দেখা গেলে যে কি স্বর্গীয় দৃশ্যের অবতারণা হতো তা চিন্তা করে আফসোস করতে লাগলাম।
এদিন সকাল ছিল কুরবানি ঈদের দিন, প্রথম বাসার বাহিরে ঈদ করছি, তার উপর গত ২ দিন বাসায় কথা বলতে পারি নাই মোবাইলের নেটওয়ার্ক ছিল না বলে। বেস ক্যাম্প থেকে স্যাটেলাইট ফোনে কল করা যায়, মিনিট ২০০ রুপি করে। তাও একবার ফোন দিলাম বাসায় জানানোর জন্য যে ভালো আছি। তার ৩০ মিনিট পর নাস্তা করে আমরা বের হয়ে গেলাম ফেরার পথে। ব্যাস ক্যাম্প থেকে চলে যাবার সময় আরও একবার ভালো করে চারিদিক দেখে নিলাম। আর আসা হয় কি না হয়। মনে মনে বললাম, আমি আবার আসব, জানি না কবে, কিন্তু অবশ্যই আসব।
Annapurna Base Camp অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প

বেস ক্যাম্প থেকে ফেরত আসার সময় এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়। পাহাড়ের ঢালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় একটা বিশাল পাথরে পিছলা খেয়ে ঢাল বেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। আশে পাশে নোমান বা গাইড কেও ছিলা না। গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যেতে যেতে কোনওমতে একটা গাছ বা কিছু একটা ধরে ( মনে নাই , সব এত দ্রুত হয়েছিল যে কিছু বুঝে উঠার আগেই শেষ ) পড়ার গতি রোধ করলাম।  আমার পিছনে একটা কোরিয়ান মেয়ে ছিল, সে দৌড়ে আসল আমাকে সাহায্য করার জন্য।  কোনোমতে উঠে একটা পাথরের উপর বসে কাপতে লাগলাম ভয়ে।  সেদিন পড়ে গেলে আমার আর বাচা লাগত না, কারণ নিচেই ছিল প্রমত্ত মোদী খোলা নদী, ওতে পড়া মাত্রই পানির তোড়ে পাথরে বাড়ি খেয়ে সেখানেই হাড় গোড় গুড়া হয়ে যেত।
Annapurna Base Camp অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প

১০ম সর্বোচ্চ পর্বতের সামনে

Annapurna Base Camp অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প

এখানে আসলে সবাই মনে হয় আনমনে হয়ে যায়

ফেরত যাবার রাস্তা যেই রাস্তা দিয়ে এসেছি সেটাই। তাই এ নিয়ে বেশি কিছু বলার নাই। শুধু এইটাই বলি, অনেকে ভাবেন যে পাহাড় থেকে নামা সহজ। হয়তো উঠার সময় যে পরিমাণ এনার্জি লাগে তা হয়তো আগে না, কিন্তু অনেক সতর্ক থাকতে হয়, আর হাঁটুতে চাপ পড়ে প্রচণ্ড।  আমার এতো ভারী শরীর নিয়ে নামার সময় আমি বুঝতে পারছিলাম যে হাঁটুতে অনেক চাপ পড়ছে।
আর দিন শেষে আমার আশঙ্কাই সত্যি হল, চাপ খেয়ে ডান হাঁটু ফুলে যেয়ে এতো ব্যথা শুরু হল যে হাটাই দায়। ট্যুর শেষ করে আসার প্রায় ১০ দিন পর এই লেখা লিখছি আমি, এমনকি এখনো পায়ে অল্প অল্প ব্যথা হয়। তাই নামার সময় সাবধান, কোনও পায়ে বেশি প্রেশার দিবেন না। দোভানে অস্ট্রেলিয়ান ডেভিড আর তার ট্রেকিং পার্টনার ২ জার্মান মেলিনা আর ক্রিস্টিনার সাথে পরিচয় হল।
মেলিনা তার স্কুল লাইফ থেকে ভার্সিটি লাইফ পর্যন্ত সব সময় পার্ট টাইম কাজ করে টাকা জমা করেছিল, গত মাসে তার গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে সব টাকা নিয়ে বের হয়ে গেছে পৃথিবী ঘুরে দেখবে ১০ মাসের জন্য। এরপর চাকরি বাকরির চিন্তা। তার ওপর তার জার্মান পাসপোর্ট, ১৫৮ টা দেশে অন এরাইভাল ভিসা, আর কি লাগে। এর আগে কারো প্রতি এতো ঈর্ষা আগে অনুভব করি নাই।
তারাও যে আমাদের ঈর্ষা করে না তা কিন্তু না, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতমালা ‘হিমালয়’ আমাদের বাড়ির পাশে, দেড় ঘণ্টা লাগে প্লেন এ করে যেতে। অস্ট্রেলিয়া থেকে আসতে তাদের লাগে ১৬ ঘণ্টা , খরচের কথা নাহয় বাদ ই দিলাম। এতো কাছে থাকার পরও আমরা কয়জনই বা যাই সেখানে।  অথচ আমি সেখানে যেয়ে প্রত্যেক মহাদেশের অন্তত একজনকে পেয়েছি, সেই সুদূর চিলি, মেক্সিকো, ইউরোপ, লেবানন থেকে লোকজন এখানে চলে আসে।
Dovan nepal annapurna base camp trek দোভান নেপাল

বাম থেকে ক্রিস্টিনা, মেলিনা আর ডেভিড

এখানে আমাদের পরিচয় হয় আরেক অস্ট্রেলিয়ান এরিকের সাথে। তার সাথে কিছুক্ষণ ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করলাম। বেচারা সাপ্রতিক শ্রীলঙ্কার কাছে অস্ট্রেলিয়ার হোয়াইট ওয়াশ নিয়ে অনেক হতাশ। বাংলাদেশের ক্রিকেটেরও অনেক প্রশংসা করল। বলল ‘দে সারপ্রাইজ মি সামটাইমস’। আমি বললাম আর সামটাইমস না, এখন থেকে রেগুলারই সারপ্রাইজ করবে 😀

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।