অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেক (৫ম পর্ব) – হিমালয়া হোটেল থেকে বেস ক্যাম্প
হিমালয়া হোটেল
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার গায়ে জ্বর জ্বর ভাব নেই, শরীরও ঝর ঝরে লাগছে। আত্মবিশ্বাস আবার লাফ দিয়ে তুঙ্গে উঠে গেল। তবে তাই বলে পায়ের ব্যথা যে নেই তা না। ডাইনিং এ দেখলাম জিম সহ আরও বেশ কয়েকটি দেশের সবাই একসাথে নাস্তা করছে। সবাই অলরেডি তৈরি ট্রেক শুরুর জন্য। আমরা তাড়াতাড়ি মুখে কিছু পুড়ে দৌড় দিলাম তৈরি হওয়ার জন্য। ২০ মিনিটের মধ্যে ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেলাম। আজকে সেই দিন যার জন্য এতো কষ্ট সহ্য করে এতদূর আসা, এতো প্ল্যান প্রোগ্রাম। উত্তেজনায় মনে হচ্ছিল , ‘কখন যে পৌছব’,আর তর সইছিল না। চন্দ্র দার ভাষ্য অনুযায়ী ৭ ঘণ্টায় আমাদের পৌঁছে যাওয়ার কথা।
দিউরালি
যখন বের হলাম, আমাদের সাথে আরও অনেকেই দেখলাম রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। আজকের প্রথম স্টপেজ দিউরালি (৩২৩০ মিঃ)। নেপালে এই দিউরালি নামেই অনেক জায়গা আছে, একটা পড়বে পুন হিল থেকে আসার সময়, আরেকটা সম্ভবত নিউ ব্রিজ এর পথে। লোকাল লোকজন পাহাড়ের পাস গুলোকে দিউরালি নাম দেয় বলে জানলাম। আজ শুরু থেকেই উপরে উঠা শুরু হল, অন্যদিনের মতো আর নিচে নামতে হবে না। শুনে সস্তি পেলাম। অনেক খানি উপরে উঠে আবার নিচে নেমে যাওয়ার মতো ফ্রাসট্রেটিং আর কিছু নাই, কারণ আমি জানি আমাকে এই উচ্চতায় আবার উঠতে হবে। দেখতে দেখতে যাদের সাথে ট্রেক শুরু করেছিলাম তারা সবাই আমাকে ক্রস করে চলে গেল। এই কয়দিনে আমি এই ব্যাপারটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সবাই আমাকে পিছনে ফেলে সামনে চলে যাবে, আর আমি একা একা যেতে থাকব, এইটাই যেন নিয়ম।
৩০০০ মিটারের উপরে উঠতে থাকলে আস্তে আস্তে বড় বড় গাছের সংখ্যা কমতে থাকে, সাড়ে তিন হাজারের উপর সব বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডার জন্য ট্রেকিং শুরু করলাম জ্যাকেট পরে। পরে গা গরম হলে খুলে ফেলব। দুই ঘণ্টা পর আমরা দিউরালি পোঁছে গেলাম। এর পরের গন্তব্য ‘মচ্ছ পুচ্ছেরে বেস ক্যাম্প (৩৭০০ মিঃ)’। ।কিন্তু ঝামেলা শুরু হল এর পর থেকে। আমার ধীরে ধীরে অল্টিচুড সিকনেস অনুভব হতে লাগল।
সাধারণত ৩০০০ মিটারের উপর থেকে অক্সিজেন কমতে থাকে, এর উপরে গেলে অনেকের অল্টিচুড সিকনেস দেখা দিতে পারে। এইটা কখন কার হবে তার কোনও ঠিক ঠিকানা নাই, সবচেয়ে ফিট লোকটারও সমস্যা হতে পারে। আবার দেখা যাবে সবচেয়ে আনফিট লোকটার কিছুই হচ্ছে না। আমার বমি বমি অনুভব হতে লাগল, আর শরীর হটাত করে যেন লোহার মতো ভারী হয়ে গেল। এক একটা স্টেপ নিতে আমার সব শক্তি দিয়ে দিতে হচ্ছিল। কয়েকবার এরকম হয়েছে যে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় পিছন দিকে হেলে পড়ে যেতে থাকি। মনে হয় কে যেন পেছন থেকে টান দিচ্ছে। আর হাটার সময় তাল হারিয়ে ডানে বা বামে পড়ে যেতে থাকি। চন্দ্র দা আমার এইসব উপসর্গ শুনে বললেন যে এইটা মাউন্টেইন সিকনেস হবার সম্ভাবনা প্রবল।
মাউন্টেইন সিকনেসের উপশম দেখা মাত্র নিয়ম হচ্ছে সাথে সাথে নিচে নেমে যাওয়া। কিন্তু একবার নীচে নামলে এই পাহাড় বেয়ে আর আমার পক্ষে উঠা সম্ভব না। চন্দ্র দা আমাকে বিশ্রাম নিতে বললেন কিছুক্ষণ। আর বললেন যদি বুক বেশি ধড়ফড় করে আর শ্বাস নিতে সমস্যা হয় তাহলে যেন সাথে সাথে তাকে বলি। এইগুলো হচ্ছে এক্সট্রিম কেসের উপসর্গ। এই ধরণের কিছু হলে না নেমে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নাই।
সাধারণ উপসর্গ গুলোর জন্য একটা ঔষধ পাওয়া যায়, ‘ডায়ামক্স’। যেটা আমি কিনে নিতে ভুলে গিয়েছিলাম, যার ফল এখন ভোগ করা লাগতেছে।
চন্দ্র দার পরামর্শ অনুযায়ী ধীরে উঠতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর শরীর আরও খারাপ লাগতে লাগল, সামনে তাকায় দেখি নোমান আর গাইড কারোই দেখা নাই। অনেক সামনে চলে গ্যাসে, তাদেরও দোষ নাই, এতো মেঘ যে সামান্য দূরেই কিছু দেখা যায় না। তারা হয়তো বুঝতেই পারে নাই যে আমি এতো পিছনে পড়ে গেছি। এর মাঝে যে মালয়েশিয়ান গ্রুপের সাথে দোভানে দেখা হয়েছিল তাদের একজন পিছন থেকে আমাকে দেখে এগিয়ে আসল, আমি তখন মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলাম। সে তাড়াতাড়ি আমাকে ধরে একটা পাথরে বসাল, জিজ্ঞাস করল যে আমার সাথের সবাই কোথায়। আমার তখন মুখ দিয়ে কথা বলার ও অবস্থা নাই, ইশারা করে দেখালাম যে সামনে। সে বলল যে সামনে যেয়ে তাদেরকে জানাচ্ছে যে আমার অবস্থা খারাপ। আমি যাতে বসে থাকি।
বলে চলে গেল। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা, আমি এই অবস্থাতেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার উঠতে থাকলাম। আশে পাশের গাছ আর পাথর গুলোকে ধরে ধরে উঠছিলাম যাতে পড়ে যেতে গেলে ব্যাল্যান্স করতে পারি। ১০ মিনিট হাটার পর দেখলাম নোমান দের। ওদের পাশে যেয়ে ধপ করে বসে পড়লাম। চন্দ্র দা কে বললাম আমার পক্ষে আজ বেস ক্যাপ যাওয়া সম্ভব না, রাতটা মচ্ছ-পুচ্ছেরে বেস ক্যাম্প এ থাকতে হবে। চন্দ্র দা বললেন আগে ঐ পর্যন্ত চলেন, তারপর দেখা যাবে। এরপর থেকে চন্দ্র দা আমার পিছে পিছে হাটতে লাগলেন, পাছে আমি পড়ে যাই সেই ভয়ে।
মচ্ছপুচ্ছেরে বেস ক্যাম্প
আমি বড় বড় পাথরের সিঁড়ি গুলো অলমোস্ট হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। এইভাবে প্রায় ২ ঘণ্টা চলার পর কোনওমতে ফিশটেইল বেস ক্যাম্প পৌঁছলাম। ঐ খানে যেয়েই বললাম যে আমি আজ আর সামনে যেতে পারবোনা, গেলে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। নোমানের মুখ থমথমে হয়ে গেল, সে আমাকে সাহস দিল যে এইখানে লাঞ্চ কর, ১ ঘণ্টা রেস্ট নে, তারপর ডিসিশন নিব। মালয়েশিয়া গ্রুপ ইতোমধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছে। তাদের টিমের একজন আমাকে একটা ‘ডায়ামক্স’ ট্যাবলেট দিয়ে গেল। এই সামান্য একটু সাহায্যের কারণেই নাকি ২০ মিনিট শুয়ে থাকার জন্য জানিনা, আমার ১ ঘণ্টা পর মনে হল যে আগের চেয়ে একটু ভালো অবস্থায় আছি। চন্দ্র দা কে বললাম, লেটস পুশ। দেখি কি হয়।
অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প
এবার শুরু হলো আমাদের ট্রেক এর ফাইনাল স্ট্রেচ, গন্তব্য অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প। নরমাল ট্রেকার দের জন্য এই দূরত্ব দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগে। এর বেশির ভাগই সামান্য ঢালু, ধীরে ধীরে উপরে উঠতে হয়, তাই প্রেশার পরছিল কম শরীরের উপর। বাতাসে অক্সিজেনের স্বল্পতা টের পেতে শুরু করলাম, ঘন ঘন শ্বাস নিতে হচ্ছে, খুব অল্পতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছি। আর আমার বমি বমি ভাব তো আছেই। মাঝে মাঝেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠছিল। নোমানের মতো স্ট্যামিনা অলা বান্দারও খবর হয়ে যেতে লাগল, সেও হাটার গতি স্লো করে দিল। এর মাঝে আরও অসাধারণ কিছু ঝরনা দেখলাম। আর পুরো ট্রেকেই আপনার পাশ দিয়ে ছোট একটা ঝরনা বয়ে যাবে। অনেক ভেড়া দেখলাম চড়ে বেড়াচ্ছে।
এইদিকে তাপমাত্রা কমতে কমতে ৪ ডিগ্রীতে এসে ঠেকেছে। বাংলাদেশে জীবনে কখনো ১৪ ডিগ্রীর নিচে ঠাণ্ডার অভিজ্ঞতা হয়নাই। এখানে এসে একে তো এতো ঠাণ্ডা তার উপর হচ্ছে বৃষ্টি, সাথে আমাদের আরও ভোগানোর জন্য শুরু হল দমকা বাতাস। ঠাণ্ডায় হাতের আঙ্গুল সব অবশ হয়ে গেল। পায়ের আঙ্গুল তো ভিজা মোজা পড়ে থাকার কারণে সেই সকাল থেকেই টের পাচ্ছি না। ছবি তুলতে গেলে ক্যামেরার সাটার চাপতে পারি না, হাত এতো অবশ হয়ে ছিল।
আর বৃষ্টিতে রাস্তা পুরো কাঁদা হয়ে ছিল। মাঝে মাঝেই কাদার মধ্যে পুরো বুট ডুবে যাচ্ছিল। চন্দ্র দা বললেন আর কিছুক্ষণ , তারপরেই আমরা পৌঁছে যাব। মেঘের কারণে কিছুই দেখতে পারছিলাম না সামনে। আমি জানি বেস ক্যাম্প পৌঁছানোর আগে একটা সাইনবোর্ড আছে, কত রাত ঘুমানোর আগে স্বপ্ন দেখেছি একদিন আমিও ঐখানে থাকব। আমার মোবাইলে ওয়ালপেপার হিসেবে অন্নপূর্ণার ছবি দেয়া বহুদিন ধরে। প্রতিবার ফোন হাঁতে নিলেই আমি ভাবতাম একদিন সামনা সামনি দেখব একে।
আমার এতো সব স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হতে মাঝে আর মাত্র মিনিট খানেকের দূরত্ব। উত্তেজনায় শরীর খারাপ ,পা ব্যথা, ঠাণ্ডা সব ভুলে গেলাম। রীতিমত দৌড়ানো শুরু করলাম। দূরে আবছা ভাবে মেঘের মাঝ থেকে সাইনবোর্ডের অবয়বের মতো কিছু একটা ভেসে উঠল। দেখে আমি আর আমার আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না, চোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরতে লাগল। আমি পেরেছি, কত সংশয়, কত বাঁধা , কত মানুষের অবিশ্বাস উপেক্ষা করে আজ আমি এখানে। কাঁদতে কাঁদতে চন্দ্র দাকে জড়ায় ধরলাম। অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে কিছু ফটো সেশন হল।
এখান থেকে বেস ক্যাম্পের লজ আরও মিনিট পাঁচেকের রাস্তা, আমরা এগুতে থাকলাম। আমি সামনে যাই আর অবাক হই, বিস্মিত হই, এতদিন যেই জায়গার ছবি আমি পিসি তে দেখতাম , আজ আমি এখানে। আমার ভয় হচ্ছিল যে এটা না আবার স্বপ্ন হয়, আমি যে বাস্তবেই আছি বিশ্বাস হচ্ছিল না। এই অনুভূতি আসলে লিখে প্রকাশ করার মতো না, এর জন্য আপনাকে এখানে আসতে হবে, নিজের চোখে দেখতে হবে সব। আমার চোখ থেকে আরও কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
বেস ক্যাম্পের রুম এ ব্যাগ রেখে শুকনা কাপড় পড়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ চলে গেলাম। বাইরে তখন ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা। আর এতো মেঘ যে কিছু দেখাও যাচ্ছিল না, তাই বাইরে থাকার কোনও কারণ নেই। বেস ক্যাম্পের ডাইনিং যেয়ে দেখালাম বিভিন্ন দেশের প্রায় জনা তিরিশেক লোক বসে আছে, আমি আর নোমান ২ জন একটা জায়গা বের করে কফি নিয়ে বসলাম। এরপর বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড ও কোরিয়া থেকে আসা কয়েকজন এর সাথে বসে কার্ড খেললাম। ইতালিয়ান আলেসান্দ্রোর সাথেও আড্ডা হল অনেক, সে তার গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে এখানে এসেছে, সে আবার জাতিতে জার্মান। মালয়েশিয়ান গ্রুপ দের ধন্যবাদ দিলাম ঔষধ দিয়ে সাহায্য করার জন্য। রাত পর্যন্ত সবার সাথে আড্ডা দিয়ে রুমে চলে গেলাম।
রুমের তাপমাত্রার সাথে আমাদের দেশের ফ্রিজের তাপমাত্রার খুব একটা পার্থক্য ছিল না। ব্যাগ থেকে শুরু করে জামা, মোবাইল, মানিব্যাগ সব বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আছে। আমার নিউমার্কেট থেকে কিনা ঢাউস জ্যাকেটের উপর লেপ দিয়ে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু তাতেও শীত কিছু কমল বলে মনে হল না। ঐদিন আবার ছিল পূর্ণিমা। আলেসান্দ্রো বলেছিল যে রাত ১২ টার দিকে নাকি পূর্ণিমার চাদের আলো পাহাড়ের বরফের উপর পড়লে অসাধারণ লাগে দেখতে। তাই ১২ টার দিকে এলার্ম দিয়ে রাখলাম।
এলার্ম দেয়ার আসলে কোনও দরকার ছিল না, হায়ার অল্টিচুডে অক্সিজেন কম থাকার কারণে রাতে ঘুমই আসে না। সারা রাত এপাশ ওপাশ করে কাটাতে হয়। ১২ টার দিকে একবার উঠে একটু বাইরে গেলাম কিছু দেখার আশায়। যেয়ে দেখি ধুমসে বৃষ্টি হচ্ছে, চাঁদ পাহাড় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মন খারাপ করে এসে ঘুম দিলাম। আর আশা করতে লাগলাম কালকে মেঘ কেটে যাবে আর আমি আমার সাধের অন্নপূর্ণা দেখতে পাব।
লেখা ভালো লাগলে নিচে লাইক বাটনে ক্লিক করে শেয়ার করুন
পরবর্তী লেখা গুলোর আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
রাকিবুল হাসান
অসাধারণ। আর কিছু বলতে চাই না। আমরা কয়েক জন এই টুরে যেতে চাচ্ছি।কার সাথে যোগাযোগ করলে একটু বিস্তারিত জানা যাবে বা এই ব্যাপারে একটু সাহায্য কামনা করছি।
admin
আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, facebook.com/shrek0001 আপনাদের প্ল্যান শুনে হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারবো
Shohan
khub valo laglo apnar blog pore,,,,,,
admin
ভালো লেগেছে শুনে ভালো লাগলো 🙂