অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেক-১ম পর্ব (কাঠমান্ডু)
শুরুর কথা
এই সেকশনে যাত্রা পূর্ববর্তী প্রস্তুতি নিয়ে ব্যাপক বকবক করা হয়েছে, যাদের এসব পড়ার ধৈর্য্য নাই তারা চোখ বন্ধ করে পরবর্তী সেকশনে চলে যান
ছোট বেলায় স্কুলে পড়ার সময় হিমালয় পর্বতমালার নাম শুনে নাই, এমন বোধহয় একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। একটা সময় হিমালয় আর এভারেস্টকে একই জিনিস ভাবতাম,’পর্বতমালা’ র শব্দের অর্থই বুঝতাম না। আমার কল্পনার গণ্ডীও ছিল অল্প, আমি ভাবতাম এভারেস্ট বুঝি বিশাল বড় এক পাহাড়, আর তার আশে পাশে সব আমাদের মতো সমতল ভূমি। ভুল ভাঙল আরও বড় হয়ে, যখন জানলাম হিমালয় হাজার হাজার মেইল জুড়ে বিস্তৃত অনেক গুলো বিশাল বিশাল পর্বতের এক সমাহার। তখন থেকেই পাহাড়ের প্রতি আমার এক টান তৈরি হয়।
ইন্টারনেটে যখন লাদাখের পাহাড় গুলো দেখতাম তখন মন হুহু করে উঠত। ‘থ্রি ইডিয়টস’ মুভির শুরুতে নাম দেখানোর সময় যখন শিমলার ল্যান্ডস্কেপ দেখতাম, ভাবতাম, যেভাবেই হোক, একদিন এখানে যেতেই হবে। কিন্তু কখনো সাহস করে উঠা হয়নি।পাসপোর্ট করানোর ঝক্কি ঝামেলার ভয়ে আমার সব কল্পনা, কল্পনাই থাকল।
এর মাঝে একদিন অফিসের নাজমুল ভাই এসে বললেন, ‘আলম,নেপাল যাবা নাকি?’ আমি তো শুনে তড়াক করে উঠলাম, যাব মানে? আলবৎ যাব। উনি বললেন, পরশু দিন পাসপোর্ট করাইতে যাব, কাগজপত্র সব রেডি কর। এতদিন একা এই ঝামেলায় যাওয়া হয়নি, ভাবলাম, এখন না করা হলে আগামী ১ বৎসরেও হবে না। সাথে আবার ‘সাদ্দাম’ও যোগ হল। ১ মাস পর পাসপোর্ট হাতে পেলাম আর সব সময়ের মতো, যাদের নেপাল ট্যুরের আগ্রহে পাসপোর্ট টা বানাইলাম, তাদের আর কোনও খবর নাই। আমি জিজ্ঞাস করি ‘ভাই কবে যাবেন?’- আরে ভাই, হাতে কত কাজ, সময়ই তো নাই। দেখি নেক্সট বন্ধে।
সেই নেক্সট বন্ধ আর আসে না, আর আমার পাসপোর্টের উপর ধুলা জমে। শেষমেশ নিজেই বসলাম ট্যুর প্ল্যান করতে। ঠিক করলাম ‘অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প’ যাব। এইখানে বলে রাখা ভাল, আমার ওজন ১২০কেজি মাত্র ।তাই অনেকেই এই প্ল্যান শুনে বলল, মইরা যাবি, উঠতে পারবি না, আগে ব্যায়াম কর, ট্রেনিং কর, বান্দরবন ঘুইরা আয় ইত্যাদি নানান কথা। আমি বুঝলাম এখন যদি প্ল্যান করি ওজন কমে ৯০ তে আসলে তারপর অথবা বান্দরবন আগে ঘুইরা তারপর যাব তাহলে আবার আমার পাসপোর্টে ধুলা জমবে। ইটস নাও অর নেভার।
জ্যোতি রাজি হল আমার সাথে যাওয়ার জন্য। সময় লাগবে ১০ দিন, যাওয়া আসা আর ট্রেক সব মিলিয়ে। প্রাইভেট চাকরি করি, হটাত করে যেয়ে যদি বসকে বলি যে ১০ দিন ছুটি দেন,তার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়ায় দেয়া যায় না। তাই ঠিক করলাম কুরবানি ঈদের বন্ধে চলে যাব। জীবনে কখনো বাবা মা ছাড়া ঈদ করি নাই আগে, তাই সিদ্ধান্তটা অনেক কঠিন ছিল আমার জন্য। ইতোমধ্যে নোমান আমাদের প্ল্যান শুনে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল।
ঈদের তখনো মাস খানেক বাকি, আমি প্ল্যান শুরু করলাম। কই যাব, কোথায় থাকব,গাইড নিব কিনা ইত্যাদি এইসব বিষয়ে যত ব্লগ আর ভিডিও আছেসব দেখতে থাকলাম। এরপর আসলো সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ, জ্যোতি একটা ব্যক্তিগত ঝামেলার কারণে যেতে পারবেনা বলে জানালো। তার যাওয়ার ইচ্ছার কোনও কমতি ছিল না , কিন্তু উপায় নাই।
এইদিকে এখন আমার অন্ধের যষ্টি নোমানের নাই পাসপোর্ট, তারে ধইরা বাইন্ধা পাঠাইলাম পাসপোর্ট করাইতে। বন্ধু রাফসান এর ৬ মাস আগে নেপাল এ ৩ দিনের একটা ট্রেক দিয়ে আসছিল, তার কাছ থেকে গাইডের কন্টাক্ট নিলাম। হাতে আছে ১ মাস, আমি অফিসের কাজ ছাড়া সারাদিন বিভিন্ন ব্লগ পড়ি অন্নপূর্ণা ট্রেক নিয়ে, আর গাইডের সাথে পরামর্শ করি। এইদিকে প্লেন ভাড়া তর তর করে বেড়ে যাচ্ছে দেখে নোমান কে বললাম আগে টিকেট না কাটলে পরে দ্বিগুণ টাকা দিয়ে কাটা লাগেতে পারে। সে টেনশনে ছিল তার পাসপোর্ট নিয়ে, কারণ মাত্রই কয়েকদিন আগে সে এপ্লাই করে আসল, দেরি হলে তো পুরা ধরা। তাকে শান্ত করলাম এই বলে যে , ইন দেট কেস টিকেটক্যানসেল করা যাবে আর নাম মাত্র কিছু ফি কেটে রাখবে। আমি যে বিষয়টা নিয়ে টেনশনে ছিলাম না, তানা। নোমান কোনও কারণে যেতে না পারলে শেষে আমাকে একা যাওয়া লাগবে।
ততদিনে ১৫,০০০টাকার ইউ এস বাংলার টিকেট ১৯৫০০ টাকায় এসে ঠেকেছে। তাই সই । ৮সেপ্টেম্বর এ ২ টা টিকেট বুকিং দিয়ে দিলাম , ১৮ সেপ্টেম্বর রিটার্ন সহ । আল্লাহর রহমতে পাসপোর্ট টাইম মতই বের হল। নোমানের চেয়ে বেশি খুশি মনে হয় আমি হলাম, যাক ,আমার সাধের হিমালয় দেখার পথে অর্ধেক আগায় গেলাম। কিন্তু এতো সহজে সবকিছু হবার নয়। নোমানের বোনের বিয়ে কথা বার্তা চলছিল।সে একদিন ফোন করে বলল, “দোস্ত, ঘটনা তো ডিস্টার্ব, বড় বোনের বিয়া ঠিক হচ্ছে, যদি ৮তারিখের পরে হয়, তাহলে ট্যুর ক্যানসেল”। আবার আমার টেনশন শুরু।
এক সময়ের কলিগ আর ভার্সিটির বড় ভাই ৫ জন ও আবার সেই সময় অন্নপূর্ণা যাবার প্ল্যান করছিল, তাদের ফোন দিলাম যে তাদের সাথে যাওয়া সম্ভব কিনা। গাইড কে বললাম ভাই, খরচ টরচ একটু কমায় রাখাযায় কিনা, ২ জনের জায়গায় ১ জন আসতেছি। মানে আমি ধরেই নিসিলাম যে একা যাওয়া লাগবে। ভাগ্য হয়তো আমার প্রতি সুপ্রসন্ন ছিল, নোমানের বোনের বিয়ে ঠিক হল ৭ তারিখ রাতে। মানে যেদিন আমরা যাব তার ঠিক আগের দিন। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাওয়ার আগে টুকিটাকি শপিং করলাম।১০০ লিটারের দানবীয় ম্যাক্স ব্যাগ কিনলাম। আর কিনলাম বহুদিনের শখের ১ জোড়া উডল্যান্ড বুট, যাদের নিজেদের ওজনই মনে হয় ৩ কেজি । আর ট্যুরের জন্য আগেই কিনেছিলাম গরিবের একশন ক্যামেরা ‘গিক প্রো’।
ফ্লাইট ছিল ৮ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩ টায়। আমি অফিসের একটা মিটিং সেরে ১ টার মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌছে গেলাম। যেয়ে নোমান কে ফোন দেই,কিন্তু বসের ফোন বন্ধ। প্রায় ১৫ ২০ মিনিট টানা ফোন দিয়ে গেলাম, বন্ধ ত বন্ধই। ওর আশে পাশের কাওকে যে ফোন দিব সেই নাম্বারও নাই। এদিকে তার প্লেন এর টিকেট আমার কাছে। কোন প্লেন এ কই যাব এইসব নিয়া তার কোনও আইডিয়াও নাই, কারণ সম্পূর্ণ প্ল্যান আমার করা। তাই ওকে রেখে ভিতরে ঢুকতেও পারতেছিনা। ১.৩০এর দিকে তার ফোন অন পাইলাম, বলল যে আর ৫ মিনিট লাগবে। মনে একটু শান্তি আসল, আমি ত ভাবা শুরু করে দিয়েছিলাম যে তীরে এসে বুঝি এখন তরী ডুবে।
১মদিনঃ ( কাঠমান্ডু )
গাট্টিবোসকা সব লাগেজে দিয়ে প্লেনে এ উঠে বসলাম। লাইফের প্রথমবার ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার ক্রস করব, চিন্তা করেই একটু উত্তেজিত লাগছিল। প্লেন জার্নিটাও বলার মতো ছিল। ৩০ মিনিট ফ্লাই করার পরই ছোট খাটো ঝড়ের মধ্যে পড়লাম আমরা। পাইলট আমাদের বলে দিল, এতে চিন্তার কিছু নাই, আমরা যাতে চিল করে বসে থাকি।
কিন্তু চিল আর করতে পারলাম কই, দেখালাম মেঘের মধ্যে দিয়ে প্লেন যাচ্ছে আর থর থর করে কাঁপছে । একটা বিদ্যুৎ যেন ঠিক আমার জানালার পাশেই চমকে উঠল। আমি আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম। নেপালের লোকাল টাইম অনুযায়ী আমরা বিকাল ৬.৪০ এ ‘ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট, কাঠমান্ডু’ এ ল্যান্ড করি। তখন বৃষ্টির কারণে কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করা মাত্রই আমারা অসাধারণ সুন্দর একটা রংধনু পেলাম।
এয়ারপোর্ট টাও অনেক ছিমছাম,সুন্দর। ঢোকা মাত্রই দেখবেন সবাই হুড়মুড় করে কি একটা ফর্ম নিয়ে ফিলাপ করছে,অন এরাইভাল ভিসার জন্য। অ বলা হয়নি, নেপাল এ কিন্তু অন এরাইভাল ভিসা দেয়া হয় আমাদের জন্য। মানে শুধু আপনার পাসপোর্ট থাকলেই চলবে, যদিও এখন এটা অনেকেই জানে।
যা বলছিলাম, আপনার ফরম ফিল আপ করার কোনও দরকার নাই। ভিতরে ঢুকে একটু সামনে আগালে দেখবেন এটিএম বুথের মতো কয়েকটা মেশিন। ঐটার উপর একটা স্ক্যানার প্যানেল দেখবেন, আপনার মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের মেশিন রিডেবল পেজটা তার উপর ধরুন। বুঝতে না পারলে এয়ারপোর্টের কর্মকর্তার সাহায্য চান। এরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার বেসিক তথ্য গুলো এন্ট্রি হয়ে যাবে। সাথে কিছু অতিরিক্ত তথ্য টাইপ করে দিতে হবে, যেমন কোথায় যাবেন নেপালে, কোথায় থাকবেন, কতদিন থাকবেন এইসব। সবশেষে মেশিনের সাথে যুক্ত ওয়েবক্যাম দিয়ে আপনার একটা সুন্দর ছবি তুলে সাবমিট বাটনে ক্লিক করুন। (মেশিন ছাড়া ম্যানুয়ালি ফর্ম ফিলাপ করলে সাথে ১ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিতে হবে )। এরপর একটি স্লিপ বের হয়ে আসবে, সেটি সহ ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে যান।
সাধারণত ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা লাগতে পারে ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে বের হতে। এয়ারপোর্টে থেকে বের হওয়া মাত্র শুরু হয়ে যাবে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের হাঁক ডাক। আমরা কাঠমান্ডু তে রাতে ছিলাম থামেল এ, সাধারণত টুরিস্ট রা আসলে এই জায়গাতেই উঠে। প্রচুর পরিমাণ হোটেল আছে এখানে, সময় আর এনার্জি থাকলে থামেলে হেঁটে হেঁটে হোটেলের ভাড়া যাচাই করে উঠতে পারেন।
আমি বিভিন্ন যায়গায় পড়ে এসেছিলাম যে এয়ারপোর্ট থেকে থামেল ৩০০ থেকে ৩৫০ নেপালি রুপি ভাড়া (শুধু রুপি বলবেন না, রুপি বললে ইন্ডিয়ান রুপিও বুঝতে পারে। কেও রুপি বললে আগে শিওর হয়ে নিন যে সে নেপালি রুপি মিন করেছে কিনা। নেপালে ইন্ডিয়ান রুপিও চলে)। এক ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে বুঝায় দিল যে ৩০০ রুপি মোঘল রাজা বাদশাহর আমলের ভাড়া, এখন ৭০০ রুপির নিচে দুনিয়ার কোনও ট্যাক্সিই যাবে না, আর যদি যায় তাহলে আমাকে ফ্রি নিয়ে যাবে। আর আমরা বাংলাদেশ থেকে আসছি, বাংলাদেশ নেপাল ভাই ভাই,ভাই কি ভাই এর কাছে বেশি চাবে? ।
আমি ভাবলাম কথা সত্য । তার কনফিডেন্স দেখে একটু ভড়কে গেলাম, নোমান কে বললাম, ভাড়া মনে চ্যাঞ্জ হইসে, চল এই ভাড়া তেই যাই। এন্ড এইটা ছিল আমার প্রথম ভুল। কি ভুল সেইটা পরে বুঝতে পারবেন। ড্রাইভার কে বললাম সামনে কোনও মানি এক্সচেঞ্জার পাইলে যাতে দাড়া করায়। এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের পাশে একটা মানি এক্সচেঞ্জার পাবেন, চেষ্টা করবেন ঐখানে ডলার না ভাঙ্গাইতে, ১ ২ টাকা কম পাবেন। ভালো হয় থামেলে যেয়ে ভাঙ্গাতে পারলে, ঐখানে প্রচুর মানি এক্সচেঞ্জার আছে, দামাদামি করতে পারেন (এইখানে টাকা ভাঙ্গাইতেও দামাদামি করতে হয়) ।
তো আমি আর নোমান ট্যাক্সি তে উঠে বসলাম। ড্রাইভারের পাশে বসল ‘লালু পান্ডে’। এই ট্যাক্সি তে তার রোল টা কি আমি বুঝলাম না, ভাড়া নিয়ে তার সাথেই কথা হয়েছিল। আমি তাই ভেবেছিলাম সে ড্রাইভার, এখন দেখি ড্রাইভার আরেকজন। ড্রাইভারের নাম ‘মনোজ’। আমার দেখা এখন পর্যন্ত সেরা ইভটিজার। এয়ারপোর্ট থেকে থামেল পর্যন্ত এমন একটা মেয়ে নাই যাকে নিয়ে সে কোনও কমেন্ট করে নাই। কোনও মেয়েকে দেখে হয়তো বলছে –‘ভগবান নে ক্যায়া বানায়া ইয়ার’, পরোক্ষণেই স্কুটারে বসা কোনও মেয়েকে বলছে – ‘আরে,হামকো ভি লে জা’।
এর মাঝে লালু পান্ডে আমাকে জিজ্ঞাস করল কোন হোটেলে যাব। আগে প্ল্যান করে রেখেছিলাম হোটেল বাজেটে যাব।এখন টুরিস্ট সিজন পুরোপুরি শুরু হয় নাই, তাই আগে থেকে হোটেল বুক করে যাই নাই।হোটেল বুক করে গেলে, নরমালি হোটেলে বললে ট্যাক্সি ওরাই পাঠিয়ে দেয়। নরমাল ট্যাক্সি ড্রাইভার দের আবার বিভিন্ন হোটেলের সাথে লিঙ্ক থাকে, ওরা যদি বুঝতে পারে যে আপনার আগে থেকে বুকিং করা নাই,তবে শিঊর থাকেন যে আপনি যেই হোটেলের নাম বলেছেন সেখানে নিয়ে যাবেনা, অন্য কোথাও দাড়া করাবে। বলবে যে আগে দেখেন, ভালো না লাগলে আপনি যেখানে বলবেন সেখানে নিয়ে যাব।
তো লালু পান্ডে আমাকে বোঝানো শুরু করল যে হোটেল বাজেট তো ভূমিকম্পে ক্যাক হইয়া গ্যাসে, ঐখানে এখন কিছু নাই,আপনারে এই হোটেলের কথা কে বলছে, যে বলছে সে নিশ্চয়ই ২ বৎসর আগে থাইকা গ্যাসে ব্লা ব্লা ব্লা। আমি এদের এই স্বভাব আগেই জানতাম, তাই বললাম, ভেঙ্গে গেলে গ্যাসে, আপনি ঐখানেই নিয়া যান। যথারীতি তারা আমাকে সেখানে না নিয়ে ,নিয়ে গেল হোটেল পিলগ্রিম। নামায় দিয়ে বলে হোটেল দেখেন, ভালো না লাগলে ……… ।
মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেল, কিছু বললাম না, শরীর সারাদিনের মিটিং আর জার্নি মিলায় অনেক টায়ার্ড হয়ে ছিল। আমরা ঐ রাতে পিলগ্রিমেই ছিলাম, ডাবল বেড ১ রাত১০০০ রুপি হিসাবে। এর মাঝে ট্যাক্সি থেকে নেমে ১০০ ডলার ভাঙ্গায় নিয়ে আসলাম, সব একবারে না ভাঙ্গানোই ভাল, সে ক্ষেত্রে দাম যাচাই করার সুযোগ পাওয়া যায়। আমার কাছে যেমন চেয়েছিল, ১০৫ রুপি পার ডলার, আমি ১০৬করে নিয়েছিলাম। যেখানে পরে থামেল থেকেই পেয়েছিলাম ১০৭ করে। বড় ডলারের নোট ভাঙ্গালে রেট ভালো পাবেন।
হোটেলে ব্যাগ ট্যাগ রেখে, গোসল করে আমরা বের হলাম থামেল ঘুরে দেখতে। সবচেয়ে যেই জিনিসটা কাঠমান্ডু তে ভালো লেগেছে তা হল ওদের ট্রাফিক রুল মেনে চলা। লেফট লেন দেখলাম সবসময় ফাঁকা রাখে, মোটরসাইকেল তো মানেই, বাইসাইকেল পর্যন্ত ট্রাফিক সিগনাল মেনে চলে। আর প্রচুর পরিমাণ স্কুটার আর মোটর সাইকেল। অনেকে মেয়ে দেখলাম স্কুটার চালাচ্ছে।
থামেলের রাস্তাটাও দেখলাম ছিম ছাম। প্রচুর পরিমাণ ট্রেকিং এর ইকুইপম্যান্ট এর দোকান। সবগুলোতে খাঁটি নকল ‘নর্থ ফেস’ এর গিয়ার পাবেন। এইখানে দামা দামিও করতে হয় ঢাকার নিউমার্কেটের মতো। একটাই পার্থক্য, ঢাকায় যেমন কোনও একটা দাম বলে দোকান থেকে বের হয়ে যাবার সময় পিছন থেকে আবার ডাক দেয়, এইখানে তেমন দেয় না (পরীক্ষিত 😛 )।
আমরা ১ টা করে ট্রেকিং স্টিক কিনলাম। ৪৫০রুপি দাম নিয়েছিল। এই স্টিক টা আগামী ৭ দিন যে পরিমাণ হেল্প করবে তা আগে থেকে ধারণা করতে পারি নাই। একটা সিম কিনে নিলাম নেপাল টেলিকম ওরফে নমস্তে টেলিকম এর ২০০রুপি দিয়ে। গিক প্রো র মেমরি কার্ড টা ভুলে না নিয়ে আসাতে আরেকটা মেমরি কার্ড ও কিনতে হল। আরেকটা মানি এক্সচেঞ্জার থেকে ১০৬.৫ রুপি রেটে২০০ ডলার ভাঙ্গায় নিলাম।
এরপর থেকে শুরু হল রেস্টুরেন্ট খোঁজা। পুরো কাঠমান্ডু তে ২ টা হালাল রেস্টুরেন্ট আছে, একটার নাম মক্কা, আরেকটার নাম মদিনা। মদিনা রেস্টুরেন্টটা গরু খোঁজা শুরু করলাম। কোনও এক কারণে নেপালের ম্যাপ গুগল ম্যাপ এ অফলাইন হিসেবে সেভ করে রাখা যায় না। সেই জন্য খুঁজে পেতে আরও ঝামেলা হচ্ছিল। লোকাল লোক জনকে জিজ্ঞাস করলে তারাও আকাশ বাতাস দেখে।
শেষে আর খুঁজে না পেয়ে হাটতে লাগলাম নরমাল রেস্টুরেন্টের জন্য। হটাত দেখলাম এক রেস্টুরেন্ট এ বাংলায় লেখা ‘বাংলা খাবার’। বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে এতো সব হিন্দি লেখার মাঝে(নেপাল আর হিন্দি ভাষার বর্ণমালা কিন্তু একই) বাংলা লেখা দেখে মনটা গলে গেল। নোমান কে বললাম, মদিনা বাদ দে, এইটাতেই যাই।
যেয়ে দেখি আমরা দোকানের একমাত্র কাস্টমার। দেখে একটু দমে গেলাম। ভাবলাম ভুল যায়গায় চলে আসলাম নাকি। নোমান একটা রুই মাছ আর আমি একটা মুরগি অর্ডার করলাম। ১৫ ২০ মিনিট পর একজন এসে খাবার দিয়ে গেল। তাকে বললাম পানি দেন, সে আর বুঝে না। কত অঙ্গী ভঙ্গি করে, মুখের কাছে গ্লাস ধরার ভাব করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে ভাই পানি দেন, কিন্তু সব জলে গেল। আমি ভাবতে লাগলাম এরা কি পানি খায় না, নাকি খেলে অন্য কোনও ভাবে খায়। পরে নোমান বলল ১লিটার মিনারেল, তারপর সে বুঝল। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
খাওয়া শেষে বিল দিতে গেলাম, দেখি একজন খাটি বাংলায় বলে উঠল ‘এই মফিজ (কাল্পনিক নাম, আসল নাম ভুলে গেসি) বিল নে”। পরে জানলাম দোকানের মালিক বাংলাদেশি, নাম শামীম । নেপাল এসে নিজের হোটেল খুলেছেন । তার কাছেই জানলাম এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি না নিয়ে একটু বের হয়ে মেইন রোড এ এভেইলেবল ট্যাক্সি পাওয়া যায় ৩০০রুপিতে। পরের দিন সকাল ৮.৩০ তে পোখারার ফ্লাইট ধরতে হবে। সকালে কোথা থেকে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে এইসব শুনে নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
লেখা ভালো লাগলে নিচে লাইক বাটনে ক্লিক করে শেয়ার করুন
পরবর্তী লেখা গুলোর আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন
Ashfaque Anim
ভাইয়া আপনার এই নেপাল ট্যুরে সর্বমোট কত খরচ হয়েছিল? আর ধন্যবাদ ভাইয়া এত সুন্দর করে আপনার ভ্রমণ কাহিনী তুলে ধরার জন্য । সত্যিই মনোমুগ্ধকর ।
admin
ধন্যবাদ 🙂
আমার প্যারাগ্লাইডিং বাদ এ প্রায় ৪০ হাজারের মতো লেগেছিল। কাঠমান্ডু থেকে পোখারা বাস এ গেলে আরো খরচ কমানো সম্ভব 🙂