দোভান থেকে ঝিনু ডাণ্ডা

চমরং

ছোটবেলা স্কুলের বাংলা বইতে সৈয়দ মুজতবা আলী’র “গ্র্যাবোভোবাসীদের রস-রসিকতা” নামে একটা গল্পে প্রথম শুনি ‘উষ্ণ প্রসবন” শব্দটা। সেখানে লেখা ছিল গ্র্যাবোভোবাসীরা ঠাণ্ডায় উষ্ণ প্রসবণের পানিতে গোসল করত। আমরা সবাই ভাবতাম এইটার মানে বুঝি ‘গরম মূত্র’ । স্কুলের স্যার রাও ব্যাপারটা ঠিক মতো বুঝায় দেয় নাই। বহুদিন পর্যন্ত আমার এই ধারণা বলবত ছিল। পরে যখন জানলাম যে ‘উষ্ণ প্রসবণ’ আসলে পাহাড়ের ভেতর থেকে বের হওয়া গরম পানির ধারা, অনেক অবাক হয়েছিলাম। পাহাড়ের ভেতরে পানি কিভাবে গরম হবে।
অবশেষে আমার সুযোগ আসলো ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করার। যেদিন শুনেছিলাম যে ঝিনু ডাণ্ডায় ‘হট স্প্রিং’ আছে সেদিন থেকেই উত্তেজিত ছিলাম যে এখানে যেতে হবে। তাই আজকে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই লাফাচ্ছিলাম যে কখন যাব। আজ আকাশের অবস্থা অনেক ভালো, কোনও বৃষ্টি নাই। প্রায় ৫ দিন পর আমরা সূর্য দেখতে পেলাম। সেই সাথে পুরো এলাকা নতুন এক রূপ নিয়ে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হল। যেসব জায়গা যাওয়ার সময় কিছুই দেখতে পারি নাই মেঘের কারণে তার সব দেখা যাচ্ছিল। হিমালয়ের সৌন্দর্য যেন তাতে আরও সহস্র গুন বেড়ে গেল।

Chomrong Nepal চমরং নেপাল

ফেরত আসার সময় চমরং এর একটু আগে

চমরং নেপাল Chomrong Nepal

মেঘের খেলা (চমরং এর ফিশটেল লজে আবার,ফেরার পথে)

চমরং নেপাল Chomrong Nepal

চমরং এর ফিশটেল লজে আবার,ফেরার পথে

কিন্তু চন্দ্র দা এক বিশাল দুঃসংবাদ নিয়ে এলেন, গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে মোদী খোলা নদী ফুলে ফেঁপে আছে, তারই পানির তোড়ে নাকি হট স্প্রিং এর টাব সব ভেঙ্গে গেছে। । ঝিনু তে পাহাড় থেকে বের হওয়া গরম পানি একটা বড় টাবের মতো জায়গায় এনে ফালানো হয়, যেখানে সবাই নেমে গোসল করে। সেই টাব গুলার কথায় বলছিলেন উনি। শুনে আমার মন এতো খারাপ হলো যে বলার মতো না। তবে উনি বললেন যে এখনই মন খারাপ করার কিছু নাই, নিউজ টা অথেনটিক কিছু না, যেয়ে আমরা চেক করে দেখব।

ঝিনু

ঝিনু তে যেতে হলে আগে চমরং যেতে হবে, সেখান থেকে খাড়া পাহাড় বেয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা নিচে নেমে যেতে হবে। আমার পায়ের ব্যথার কারণে নোমানের ওয়াকিং স্টিক টা চেয়ে নিলাম। তারপর ২ টা স্টিককে অনেকটা ক্র্যাচের মতো ব্যাবহার করে কোঁকাতে কোঁকাতে নিচে নামতে লাগলাম। আমার স্লো হবার কারণে ঝিনুতে আমরা পৌঁছলাম ৫ ঘণ্টার জায়গায়, ৬.৩০ ঘণ্টায়। সেখানে হোটেলে ব্যাগ পত্র রেখে রওয়ানা দিলাম হট স্প্রিং এর উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে আরও প্রায় ৩০ ৪০ মিনিট নিচে নামতে হবে পাহাড়ের। এ রাস্তাটা অনেক পিচ্ছিল আর শেওলা জমা। তাই আমি আরও দুবার আছাড় খেলাম ( আছাড় খাওয়া আমার জন্য নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল সেখানে, জিম তো বলেই দিল যে ‘ইউ আর লাইক এ স্ট্যান্ট ম্যান 😛 ’ )।
আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল মানতে হবে, যেয়ে দেখি পানির তোড়ে টাবের আশে পাশের কিছু জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু টাব টা অক্ষত আছে। নরমালি ৫০ রুপির টিকেট কাটতে হয় সেখানে নামতে, কিন্তু আমরা যেয়ে দেখি টিকেট যে বিক্রি করে সে নাই। ফ্রি পেয়ে গেলাম । পানিতে নামার পর মনে হল কেও যেন পানি গরম করে এখানে রেখে দিয়েছে, পাহাড়ের ভেতর থেকে এতো গরম পানি কিভাবে বের হচ্ছে মাথায় ঢুকল না। এতো ঠাণ্ডার মধ্যে এতো দূর থেকে হেঁটে এসে এই গরম পানিতে গা ডুবানোর পর যে অসাধারণ ফিলিংস হয় তা সেখানে না গেলে বোঝা সম্ভব না।
কিন্তু বেশিক্ষণ থাকার উপায় নেই, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আবার পাহাড় বেয়ে ১ ঘণ্টা উঠতে হবে হোটেল যাবার জন্য। এই কথা চিন্তা করলে মনে হয় যে সারা রাত এখানেই থেকে যাই। অনেক কষ্টে মনের বিরুদ্ধে আধা ঘণ্টা পর উঠে রওনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। এই ট্রেক টা অনেকটাই গুমোট আর শেওলা ধরা টাইপ, তাই পায়ে আরও কয়েকটা জোঁক ধরল। এই কদিনে এতো জোঁক ধরেছে পায়ে যে এখন আর এদের দেখলে কিছু মনে হয়না। একটা ফুড়ুৎ করে আমার বুটের ভিতর ঢুকে গেল। এইটাকে তো আর এখন বের করার উপায় নাই। তাই বেটাকে পায়ের ভিতরে নিয়েই হেঁটে চললাম। মনে মনে ভাবলাম যা খাওয়ার খাইয়া নে, হোটেল যাওয়ার পর তোকে লবণ দিয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করব ।

এদিন রাতে আর তেমন কিছু করি নাই, হোটেলের ছাদে বসে পাহাড়ের ফাঁকে চাদের লুকোচুরি দেখছিলাম আর চন্দ্র দা আর নোমানের সাথে আড্ডা চলল কিছুক্ষণ, তারপর ঘুম।

লেখা ভালো লাগলে নিচে লাইক বাটনে ক্লিক করে শেয়ার করুন

পরবর্তী লেখা গুলোর আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেকে র অন্য লেখা গুলো

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।