নেপাল ঘুরে আসার পর আবার আবার শুরু হল আমার গতানুগতিক ৯ টা ৬ টা অফিস। কোন বৈচিত্র্য নাই। প্রায়ই নেপালের ছবি গুলো বের করে দেখি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মন ভালো করতে বাইক নিয়ে চলে গেলাম সাজেক।  সাজেক অসাধারণ সুন্দর একটা যায়গা, কিন্তু তাও মন ভরল না। সাজেকে বসেই প্ল্যান করে ফেলি যে নেক্সট ট্যুর হচ্ছে ভুটান।

ঢাকায় এসে ক্যালেন্ডার ঘাটতে লাগলাম কবে ছুটি আছে দেখার জন্য। ২৩~২৫ সরকারি বন্ধ দেখে ভাবলাম সাথে ২ দিন ছুটি নিয়ে ৫ দিনে সুন্দর মত ঘুরা হয়ে যাবে। বসে গেলাম ট্যুর প্ল্যান করতে।

প্ল্যানিং:

এই সেকশনে কিভাবে কোথায় কোথায় যাবেন তা সম্পর্কে লিখব, কেও যদি সরাসরি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পরতে চান তাহলে এই অংশ স্কিপ করতে পারেন।

ভুটান এ বাসে বা প্লেনে দু’ভাবেই যাওয়া যায়। বাসে গেলে ইন্ডিয়ার ট্রানজিট ভিসা লাগবে। ট্রানজিট ভিসা নেয়ার জন্য কোন ই-টোকেনের প্রয়োজন হয় না। তাই ঝামেলা কম। দালাল ধরার ও প্রয়োজন নাই। http://indianvisa-bangladesh.nic.in/… এই লিঙ্ক এ সব ডিটেইলস পাবেন যে কি কি ডকুমেন্ট লাগবে। আপনার যদি আগে থেকেই ইন্ডিয়ার ভিসা থেকে থাকে তা বাতিল হয়ে যাবে ট্রানজিট ভিসা নিলে।

সাধারণত ট্রানজিট ভিসা দেয় ১৫ দিনের জন্য। যার মাঝে যাওয়ার সময় টানা ৩ দিন আর ফেরত আসার সময় টানা ৩ দিন থাকতে পারবেন। সময় আর সুযোগ থাকলে এই ৩ দিনে দার্জিলিং ও ঘুরে আসতে পারেন। বর্ডার পার হয়ে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফেলতে পারেন সরাসরি জয়গাঁও বর্ডার পর্যন্ত। ট্যাক্সি তে করে যাবার সময় পাবেন জলপাইগুড়ি জেলার চা বাগানের মনোরম দৃশ্য।

পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার জয়গাঁও হচ্ছে ভারতের শেষ সীমানা। ওপাশে ভুটান এর ফুয়েন্টশলিং বর্ডার। বুড়িমাড়ি থেকে জয়গাঁও আসতে দেড় ঘণ্টার মতো লাগবে।

নেটে একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ১০ এয়ারপোর্ট আর তাদের বর্ণনা। পরতে পরতে এক নাম্বারে এসে দেখলাম ভুটান এর পারো এয়ারপোর্ট। হিমালয়ের পাহাড়ের মাঝে ছোট্ট একটা রানওয়ে। সেখানেও ২ টা পাহাড়ের মাঝ দিয়ে অনেক কাইৎ চিত হইয়া যাইতে হয়। পারও এয়ারপোর্ট সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২৩৫মিঃ উপরে অবস্থিত, আর এর দৈর্ঘ্য হল ১২০০মিঃ। এটাই পৃথিবীর একমাত্র এয়ারপোর্ট যার রানয়ের দৈর্ঘ্য তার উচ্চতার চাইতে কম।

বলা হয়ে থাকে মাত্র ৮ জন পাইলট এখানে প্ল্যান ল্যান্ড করানোর জন্য অভিজ্ঞ, সত্যতা জানা নাই। কিন্তু সত্য হোক আর মিথ্যা, ভুটানে প্লেনে আসতে চাইলে আপনার এয়ারলাইন্স বাছাই করার খুব বেশি সুযোগ নাই। কারণ ভুটানে ২ টা আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সই যায়, একটা হল ড্রুক এয়ারলাইন্স, আরেকটা ভুটান এয়ারলাইন্স। বাংলাদেশ থেকে গেলে আপনার ড্রুক এয়ারলাইন্স ছাড়া যাবার কোন উপায় নাই।

ভুটানের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেক ভালো। ভুটানে শুধুমাত্র ২ টা দেশের এমব্যাসি আছে, একটা হল ভারত, আরেকটা বাংলাদেশ। ভুটান হল পৃথিবীর সবচেয়ে কম এমব্যাসি ওয়ালা দেশ (ভ্যাটিকান সিটি তে কোন এমব্যাসি রাখে না) ।আপনি যদি বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া বা মালদ্বীপের নাগরিক না হন, তা হলে ভুটানে যাবার জন্য আপনাকে ভিসা নিতে হবে (তথ্যসূত্র – http://www.tourism.gov.bt/plan/visa)। আপনার বাংলাদেশি পাসপোর্ট হলে ইমিগ্রেশনে কোন ঝামেলা হবে না।

বাহিরের দেশের নাগরিকরা আবার নিজেরা ভুটানের ভিসার জন্য এপ্লাই করতে পারে না। তাদের অনলাইনে কোন ট্রাভেল অপারেটরের কাছ থেকে ট্রাভেল প্যাকেজ কিনতে হয়, যার মূল্য হতে হবে কমপক্ষে ২৫০ ডলার প্রতি দিন। এর মাঝে মিনিমাম ৩ সটার হোটেলে থাকাখাওয়া, গাইড সহ সব খরচ থাকবে। এই ২৫০ ডলার থেকে নেপাল সরকার নেয় ৬৫ ডলার, বিনামূল্যে চিকিৎসা আর শিক্ষা সেবা দেওয়ার জন্য।

ভুটান সম্পর্কে কিছু কথা

এর মাঝে ইউটিউবে টেড টকের ভিডিও দেখতে দেখতে ভুটানের উপর একটা ভিডিও দেখলাম। সেখান থেকে জানলাম যে ভুটান হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেটা কার্বন নেগেটিভ। মানে তারা যত পরিমাণ কার্বন উৎপন্ন করে তার চেয়ে বেশি শোষণ করে। তাদের সংবিধানে বলা আছে যে ভুটানের ন্যুনতম ৬০ ভাগ জমিতে ফরেস্ট থাকতে হবে। অর্থাৎ তাদের সরকার থেকে গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক করা আছে।

তারা আবার রিনিউএবল এনার্জির মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরি করে কার্বন এমিসন আরও কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ভুটান যাবার আগে এই দেশ সম্মপর্কে অনেক ব্লগ পরেছিলাম। প্রত্যেকটা ব্লগে কমন ছিল যে জিনিস তা হল, ভুটানের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, আর সে দেশের মানুষের ব্যাবহার। খারাপ কিভাবে হতে হয় সেই জিনিসটাই মনে হয় এই দেশের মানুষের মাথায় ঢুকে নাই।

ভুটানের প্রধান ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ। ভুটান দেশটাই বিখ্যাত তাদের অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ আর মনেস্ট্রির জন্য। তিব্বতের কাছাকাছি হওয়ায় তাদের সংস্কৃতির সাথে তিব্বতিয়ান সংস্কৃতির মিল পাওয়া যায়। আমাদের অনেকেরই ধারণা যে ভুটানে এখনো রাজতন্ত্র চলে। এটা একসময় ছিল, কিন্তু ২০০৮ সালে তা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তিত হয়।

এদের আবার ড্রাগনের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা আছে। তাদের রাজাকে তারা স্থানীয় ভাষায় ডাকে – ”লর্ড অফ থান্ডার ড্রাগন’ নামে।

আমার ভুটান ভ্রমণ

শুরুর কথা

২৩ ডিসেম্বর যাবার ইচ্ছা থাকলেও ঝামেলা বাধল প্লেনের টিকেট নিয়ে। ২৫ তারিখ বড়দিন। বাহিরের দেশে সবার ছুটি। আর ভুটানের এয়ারলাইন্সও একটা হওয়াতে সব টিকেট বুক। বাসে যাওয়া আমার জন্য সম্ভব ছিলনা ২ টা কারণে। এক হল সময় কম। আরেক হল আমার ইতোমধ্যে ১ বৎসরের ইন্ডিয়ার ভিসা ছিল, সেইটা আর নষ্ট করতে চাই নাই।

অনেক গুঁতাগুঁতি করে শেষে ১০~১৩ তারিখের টিকেট ম্যানেজ করতে পারলাম। ৫ দিনের জায়গায় ৪ দিন ঘুরতে পারব, এই যাহ। আর এই ট্যুরে আমার সাথে সঙ্গী হিসাবে পেলাম সাব্বির ভাই কে।

প্রথম দিন

১০ তারিখ সকালে ৯.৩০ এ ফ্লাইট। তাই সকাল সকাল ২ জন এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেলাম। সাব্বির ভাই এর এটা প্রথম বিদেশ যাত্রা। উনি খুবই এক্সাইটেড। আমি এর আগে নেপাল ঘুরে আসছি। তাই এমন ভাব ধরে থাকলাম যে, এ আর এমন কি। আমি ত সকাল বিকাল দেশের বাইরে যাওয়া আসা করি। উনাকে ভাব ধরে বিভিন্ন জিনিস চিনাতে লাগলাম। কোনটারে বলে চেক ইন, আর কাকে বলে বোর্ডিং, ইমিগ্রেশন খায় না মাথায় দেয়, কিভাবে বোর্ডিং এর সময় আপনার প্যান্টের বেল্ট পর্যন্ত খুলে চেকিং করবে তার সব বর্ণনা দিতে থাকলাম।

উনি দেখলাম মনোযোগী ছাত্রের মতো সব মাথায় সেভ করে রাখতেসেন। আমার উৎসাহ আরও বেড়ে গেল, এরপর তারে চিনানো শুরু করলাম যে কোনটা জেট প্লেন, আর কোনটা প্রপেলার প্লেন। ভাব ধরে বললাম যে আজ আমরা জেট প্লেন এ যাব (আমি আগে কখনো জেট প্লেনে উঠি নাই, তাই ভিতরে ভিতরে নিজেও এক্সাইটেড) ।

কিন্তু সব আসায় গুড়ে বালি, আমাদের দেখলাম এক পাঙ্খা ওয়ালা প্লেন এর সামনে নিয়া দাড়া করায় দিল। সাব্বির ভাই জিজ্ঞাস করে, ভাই আপনার জেট ইঞ্জিনে পাঙ্খা কেন!! কবি এখানে নীরব। আমার সিট পড়ল লাস্টের আগের রো তে, আমার পিছনে সাব্বির ভাই। তার পাশের সিট কেবিন ক্রু দের জন্য বরাদ্ধ থাকায় আমি বসতে পারি নাই। প্লেন টেক অফ হবার পর আমি উঠে পিছনে চলে আসলাম। কিছুক্ষণ খাবার দাবার দেয়ার পর কেবিন ক্রু, যার নাম সোনাম (সোনম কাপুর ভেবে ভুল করবেন না) আমার পিঠে টোকা দিয়ে বলল – ‘Hey, you want a beer?’. আমি বাপ মায়ের বাধ্য সন্তান, জীবনে একটান বিড়িও খাই নাই, কিন্তু এইরকম হটাত করে একজন অফার করার পর ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। ভাবলাম না বললে ভাববে যে পোলা এখনো বাচ্চা রইয়া গ্যাসে। তাই নিজের পৌরষত্ত বাঁচানোর জন্য তার কাছ থেকে ১ টা হেইনকেনের ক্যান নিলাম।

পাশে সাব্বির ভাই অলরেডি সোনাম এর কাছ থেকে এক বোতল বিয়ার নিয়া অর্ধেক নামায় দিসে। এইখানে বলে রাখা ভালো, সোনাম রে যদি আইনা বাংলাদেশের রাস্তায় ছাইড়া দেই, সবগুলা মেয়ে সিরিয়াল ধরে ক্রাশ খাইতে থাকবে। আর বিয়ারটা প্ল্যানে শুধু কেবিন ক্রু দের জন্যই ছিল, সে সেখান থেকে আমাদের নিজের ইচ্ছায় দিয়েছিল। আমি এক চুমুক দিয়েই বুঝলাম এই জিনিস আমার জন্য না, সাব্বির ভাই কে দিইয়ে দিলাম। উনি দেখালাম মহানন্দে ২ বোতল নিয়া খাইতে থাকলেন।

তারপর নিজ থেকেই বলল, যদি আমরা পারো থাকি, তাহলে যাতে তাকে কল দেই, সে তাহলে আমাদের পারো ঘুরিয়ে দেখাবে। তারপর তার সাথে অনেক গল্প হল। এদিকে আমরা ফ্রি বিয়ার খাচ্ছি দেখে আমাদের সামনের জন পিছন ঘুরে বলল, ভাই এইটা কি সবাইরে দেয় নাকি শুধু আপনারে দিসে। আমি বললাম মনে হয় না সবাইকে দেয়। তো উনি মন খারাপ করে আবার আগের জায়গায় বসে পরলেন। কিছুক্ষণ পরে দেখি উশখুশ করে আর থাকতে না পেরে কেবিন ক্রু রে বলেই ফেলল যে ভাই আমারেও একটা দেন। তার দেখা দেখি আরেকজন, তারপর আরেকজন। এইরকম চার পাঁচ জন কে দেয়ার পর শেষে সে বলতে বাধ্য হইল যে দেখেন ভাই, এইটা দেয়ার নিয়ম নাই। তারপর আমাদের দেখায় বলল- “Because of my friends, I gave it to you.”।

পারোর কাছাকাছি চলে আসার পর শুরু হল পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে কাইত চিত হয়ে আস্তে আস্তে নিচে নামা। দুইটা পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যখন প্লেন নামছিল, বাড়ি ঘরের এতো কাছ দিয়ে যাচ্ছিল যে হয়তো চেষ্টা করলে দুই একজনের ঘরের টিভিও দেখতে পারতাম।

ঢাকায় অনেক গরম ছিল, তাই আমি আমার জ্যাকেট লাগেজের সাথে দিয়ে দিয়েছিলাম। পরনে ছিল শুধু একটা শার্ট। কত বড় ভুল ছিল ল্যান্ড করার পর পরই বুঝতে পারলাম। এমনিতে ভেতর থেকে মনে হচ্ছিল যে বাহিরে অনেক রোদ। কিন্তু প্লেন থেকে বের হয়েই দেখলাম যে এই রইদের আসলে কোন বেইল নাই। কণকণে ঠাণ্ডা, প্রায় ৭~৮ ডিগ্রী ছিল তাপমাত্রা।ভুটান এ পা দিয়েই যা চোখে পড়বে তা হল তাদের পরিষ্কার পরিছন্নতা। কোথাও এতটুকু ময়লা পড়ে নেই। আর চোখের পড়বে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা। ভুটান এর প্রায় সবগুলো বাড়িই দেখতে প্রায় একই রকম। সরকারি অফিস-আদালত থেকে শুরু করে পাবলিক টয়লেটের পর্যন্ত ডিজাইন সেইম। আর প্রায় প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব পোশাক ‘কিরা’ পড়ে থাকে।

এয়ারপোর্টের সামনে কিছুক্ষণ ফটোসেশন করে রওনা দিলাম থিম্পুর উদ্দেশ্যে। একটা ট্যাক্সি আমরা রিজার্ভ করে নিয়েছিলাম। আমার প্ল্যান ছিল আজ থিম্পু থেকে পুনাখা যাবার পারমিট নিয়ে রাখব (পুনাখা যেতে হলে আলাদা করে থিম্পু থেকে পারমিশন নিতে হয়) । আর পুনাখা যাবার ইচ্ছা ছিল রয়েল এনফিল্ড বাইকে করে। আমার বহুদিনের স্বপ্ন যে একটা রয়েল এনফিল্ড চালাব । আজই বাইক ভাড়া করে কাল সকালে চলে যাব পুনাখা।

ভুটান পারো এয়ারপোর্ট Paro airport bhutan
ভুটানে নেমে খুশি তে ভুষি হয়ে যাওয়া সাব্বির ভাই, সাথে আমি। ফটো ক্রেডিট ট্যাক্সির ড্রাইভার

কিন্তু সব সময় প্ল্যান মতো সব কিছু কি হয়। ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একেবেকে যাচ্ছিলাম। রাস্তার পাশেই এক পাহাড়ি নদী। দেখে মনে হচ্ছিল যেন ইউরোপে চলে এসছি।ড্রাইভার আমাদের জিজ্ঞাস করতে লাগল যে কোত্থেকে এসেছি, কয়দিন থাকব, কোথায় যাব এসব। সে আমাদের প্ল্যান শুনে বলল যে “আজ তো পারমিট নিতে পারবেন না, অফিস বন্ধ”। আমার তো মাথায় বাজ পড়ল। একেতো অনেক কম সময় নিয়ে এসেছিলাম, তাই প্রতিটা ঘণ্টা আমার কাছে গুরত্তপূর্ণ।

সাব্বির ভাই আমাকে জিজ্ঞাস করতে লাগল যে ভাই কি করবেন। আমি চুপ করে এক মিনিটের মধ্যে তাড়াতাড়ি পুরো প্ল্যান আবার রিশিডিউল করে ফেললাম। তারপর চিন্তা করে দেখলাম যে কোন প্লেস বাদ পড়ে যায় কিনা। তারপর ড্রাইভার কে বললাম যে গাড়ি ঘুরান, আজ আমরা চে লে লা পাস যাব।

চে লে লা

চে লে লা পাস সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৩৯৮৮মিঃ উঁচু, প্রায় ১৩০০০ ফিট এবং এটি হচ্ছে ডান্তাক রোডের সবচাইতে উঁচু স্থান। এখানে যাবার জন্য প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে একে বেকে আপনাকে উঠে যেতে হবে। হঠাৎ করে ঢাকার মত সমতল যায়গা থেকে ২ ঘণ্টার ব্যবধানে এতো উপরে উঠে যাওয়ায় আমার মাথা ব্যথা আর বমি বমি লাগতে লাগল। কিন্তু আশে পাশের সৌন্দর্যের কাছে তা ছিল অতি তুচ্ছ। আরেকটা জিনিস যেটা চোখে পড়ার মতো তা হল এদের রাস্তের পাশে সিমেন্টের ফলকে লিখে রাখা ড্রাইভার দের জন্য সতর্কবাণী। যেমন –

  • Be Mr. Late, not Late Mr.
  • Peep peep, don’t sleep
  • If you are married, divorce speed
  • He who touches ninety, flies to die at nineteen
  • Drive fast and test out rescue
  • Fast isn’t always first
  • After drinking whiskey, driving is risky

পাসের একদম কাছে এসে চোখে পড়ল ‘জমলহারি’র বরাফাবৃত পিক। এর উচ্চতা ৭৩২৬ মিঃ অথবা ২৪০৩৫ ফিট, ভুটানের ২য় সর্বোচ্চ পিক। অনেকে জমলহারিকে কাঞ্চনজঙ্ঘার বৌ (The bride of Kanchenjunga) ও বলে থাকে। এই পাহাড় থেকেই তৈরি হয়েছে পারো নদী।

তিব্বতি বৌদ্ধ রা এই পাহাড়কে অনেক পবিত্র মনে করে।তারা মনে করে এই পাহাড় পাঁচ ‘শারিংমা বোন’ (Tsheringma Sisters) এর একজনের বাসস্থান ছিল। এই শারিংমা দের কাহিনী বলতে গেলে আরেক ইতিহাস শুরু হয়ে যাবে। শুধু এইটা বলে রাখি যে এই পাঁচ বোন ‘গুরু পদ্মসম্ভভা’ এর কাছে শপথ করে বৌদ্ধ দের সংস্কৃতি ও স্থানীয় জনগণদের রক্ষা করার। বৌদ্ধরা এইটাও ধারণা করত যে ,যেহেতু এই পাহাড় পবিত্র, তাই কেউ এর চুড়ায় যেতে পারবে না। যেতে চাইলে তাকে ফেলে দেয়া হবে। ১৯৩৭ সালে এক ব্রিটিশ এক্সপেডিশন টিম কে সামিট করার অনুমতি দেয়া হয় এবং তারা ২১ মে, ১৯৩৭ এ এর চুড়ায় উঠে। তাদের কেন ফালায় দেয় নাই মাথায় ঢুকল না।

Jomolhari, che le la pass , Bhutan জমলহারি চে লে লা পাস পারো ভুটান
জমলহারির সামনে ভাই

যাই হোক, পাসের উপর যেয়ে দেখি ছোট একটা টং এর মত দোকান আর দোকানের পাশে ২ টা কুকুর। সেখানে প্রথম সাব্বির ভাই এর কুকুর প্রেম সম্পর্কে যানতে পারলাম। উনি দেখি কুকুর ২ টাকে বুকে জড়ায় বসে আছেন। এরপর ভুটান এর রাস্তায় এর পর যতগুলা কুকুর সামনে পড়ছে সবগুলার সাথে উনি যেয়ে কুলাকুলি করে আসছেন। বাংলাদেশে তাকে এমনটা করতে দেখা যায় না। রেসিস্ট 😛

Che le la pass, paro Bhutan চে লে লা পাস পারো ভুটান
ভাই এর ভাই ব্রাদার গণ

পাসের পাশে একটা উঁচু জায়গা ছিল। আমরা ভালো ভিউ পাবার জন্য টং থেকে পানি, চিপস আর একটা ড্রাই ফ্রূটের প্যাকেট কিনে হাটা দিলাম। ৫ মিনিটেই আমার দম শেষ। এই আমিই ২ মাস আগে কিভাবে অন্নপূর্ণা ট্র্যাক দিয়ে আসছিলাম ভেবে পাই না। সাব্বির ভাই দেখি তর তর করে উঠে যাচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে বিস্বাদ একটা ড্রাই ফ্রুট খেতে খেতে উঠতে লাগলাম।

হিমালয় রেঞ্জের প্রায় সব জায়গাতেই বৌদ্ধদের টাঙ্গানো প্রেয়ার ফ্ল্যাগ চোখে পড়ে। ভুটানও তার ব্যতিক্রম না। কিন্তু এখানে এসে কিছু অন্য রকম শেপের প্রেয়ার ফ্ল্যাগ দেখলাম। সাদা একটা কাপড়, পতাকার মতো একটা বাঁশের সাথে লম্বাভাবে লাগানো। এরকম আগে কখনো দেখি নাই, জানাও ছিল না। প্রথমে ভেবেছিলাম পতাকা টাইপ কিছু বোধহয়।

কিছুদূর উঠে যাবার পর সারি সারি বিশার সব পাহাড় আর তাদের মাঝের উপত্যকায় ছোট ছোট বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে দেখতে লাগলাম। আমার ক্যামেরা সাব্বির ভাই এর কাছে দিয়ে দিয়েছিলাম। উনি একটার পর একটা শাটার মারতে থাকলেন।

Che le la pass, paro Bhutan চে লে লা পাস পারো ভুটান
চে লে লা পাস পারো ভুটান

সেখানে কিছুক্ষণ ফটোসেশন করে আমরা ফেরা পথ ধরলাম।আমার এমনিতেই মাথা ব্যথা, তার উপর এই পাহাড়ে উঠানামা করতে যেয়ে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম। ট্যাক্সিতে উঠে তাই হা করে ঘুমাতে লাগলাম। এর মাঝে নাকি আমার ঘুমানোর ছবি টবিও তোলা হয়েছে। সাব্বির ভাই ভুলটা করেছিল আমার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে। বিশ্ববাসী আর আমার এই হা করে ঘুমানোর ছবি দেখতে পাচ্ছে না। ঘুম ভাঙ্গার পর দেখলাম ট্যাক্সি রাস্তার পাশে দাঁড়ানো। পাশে একটু নিচে একটা লম্বা সোজা রাস্তা আর সেখান দিয়ে একটা প্লেন ট্যাক্সিং করে যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠার কারণে কিছুক্ষণ ধান্ধা খাইয়া ছিলাম যে হইতাসে কি। পরে বুঝলাম আমরা পারো বার্ডস আই ভিউ পয়েন্টে আছি। এইটা এয়ারপোর্টের পাশেই একটু উঁচুতে একটা রাস্তা যেখান থেকে পুরো এয়ারপোর্টের একটা প্যানারমিক ভিউ পাওয়া যায়। ততোক্ষণে বিকাল হয়ে এসেছে, ঠাণ্ডাও বাড়ছে, আমি তাও একটা শার্ট পরেই বসে আছি। আলসেমি করে ব্যাগ থেকে জ্যাকেট বের করা হচ্ছে না। এখানে কিছুক্ষণ সময় পার করে পারো সিটি তে চলে গেলাম।

ভুটান এর অন্য লেখা গুলো

ভুটান ভ্রমণ ২য় পর্ব (টাইগার্স নেস্ট)
ভুটান ভ্রমণ ৩য় পর্ব (থিম্পু পুনাখা বাইক রাইড)

লেখা পড়ে ভালো লাগলে শেয়ার বাটনে ক্লিক করে শেয়ার করুন

পরবর্তী লেখা গুলোর আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।